‘এমনও হতে পারে যে, এই শরীরটাকে পুরনো কাপড়ের মতো ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে এর বাইরে চলে যাওয়াই আমি শ্রেয় মনে করব। কিন্তু কখনও আমি কাজ থেকে বিরত হব না। সর্বত্র আমি মানুষকে অনুপ্রেরণা দিয়ে যাব, যতদিন না প্রতিটি মানুষ বুঝতে শেখে যে সে ভগবান।’-এই প্রতিশ্রুতি নিজেই দিয়ে গেছেন স্বামী বিবেকানন্দ।

আজ ৪ঠা জুলাই, ১৯০২ খ্রিষ্টাব্দের এই দিনে স্বামীজী দেহত্যাগ করেন। সন্ধ্যাবেলা বেলুড় মঠে নিজের ঘরে ধ্যান করছিলেন। রাত ৯টা ১০ মিনিটে সেই ধ্যানই মহাসমাধিতে পরিণত হয়। বয়স হয়েছিল ৩৯ বছর ৫ মাস ২৪ দিন। তাঁর স্থুলদেহের নাশ হলেও যে শক্তি বিবেকানন্দ রূপে আত্মপ্রকাশ করেছিল, সূক্ষভাবে তা কাজ করে চলেছে এখনও। যা প্রমান দিচ্ছে স্বামীজীর দেওয়া প্রতিশ্রুতিরই। তাঁর স্বল্প পরিসর জীবনে তিনি নিরলস কাজ করে গেছেন জগতের কল্যাণে, আর যে কারণে আজ পৃথিবীব্যাপী স্বামী বিবেকানন্দ এক মহান আদর্শ, অনুপ্রেরণা ও পূজনীয়।

শ্রীরামচন্দ্রের সঙ্গে তাঁর কাজ করার জন্য মহাবীর এসেছিলেন। শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে সঙ্গে এনেছিলেন: শ্রীরামকৃষ্ণ নিয়ে এলেন এই মহাশক্তি - বিবেকানন্দকে।

বীরেশ্বর শিবের আশীর্বাদে মাতা ভুবনেশ্বরী দেবী ও পিতা বিশ্বনাথ দত্তের কোল আলো করে ১৮৬৩ খ্রিষ্টাব্দের ১২ জানুয়ারি পৌষ-সংক্রান্তির দিন খুব সকালবেলা জন্মগ্রহণ করেন স্বামী বিবেকানন্দ। বীরেশ্বর শিবের বরে ছেলেকে পেয়েছেন বলে মা তার নাম রাখে ‘বীরেশ্বর’। সংক্ষেপে সবাই তাকে ‘বিলে’ বলে ডাকত। অন্নপ্রাশনে নামকরণ হয় নরেন্দ্রনাথ দত্ত। ছেলেবেলায় বিলে খুব দুরন্ত ছিল, রগও ছিল প্রচণ্ড। শিশু বয়সে তার পছন্দের খেলা ছিল চোখ বুজে কোলের ওপর হাত রেখে চুপটি করে বসে থাকা(ধ্যান), যেন বুদ্ধদেবটি। ছেলেবেলা থেকেই তিনি খুব দয়ালু ছিলেন, অন্যের দুঃখ-কষ্ট দূর করার চেষ্টা করতেন। ছেলেবেলা থেকে অপরের জন্য ভাবতে না শিখলে কেউ কি আর বড় হয়ে দেবতার মতো হয়, মহাপুরুষ হয়? বিলে খুব সত্যনিষ্ঠ আর মেধাবীও ছিলেন, শিক্ষক তাকে পড়ে শুনাতেন আর তা শুনেই তাঁর সব মুখস্ত হয়ে যেত। তিনি অত্যন্ত সাহসী ও কর্তভ্যপরায়নও ছিলেন শিশুকাল থেকেই।

নরেন্দ্রনাথের ভগবানের প্রতি মনের টান শিশুকাল থেকে থাকলেও তা প্রবল রূপ ধারণ করে কলেজে পড়াকালীন। ভগবানলাভ করার জন্য তিনি ব্যাকুল হয়ে উঠলেন। ধার্মিক লোক দেখলেই নরেন্দ্রনাথ প্রশ্ন করতেন, “আপনি ভগবানকে দেখেছেন?” কিন্তু “হ্যাঁ দেখেছি” এ সোজা উত্তর কারো কাছে পেলেন না। শেষে এই সহজ উত্তরটি পেলেন দক্ষিণেশ্বরে শ্রীরামকৃষ্ণদেবের কাছে। নরেন্দ্রনাথ ঠিক ঠিক গুরু পেয়ে গেলেন, তবে নানাভাবে পরীক্ষা করার পর নরেনন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে নিজেকে সমর্পন করেন।

নরেন্দ্রনাথ ঈশ্বরোপলব্ধির পর ভেবেছিলেন, আগেকার দিনের মুনি-ঋষিদের মতো বসে বসে ধ্যান করে কাটাবেন। কিন্তু শ্রীরামকৃষ্ণদেব বললেন, “তা তো হবে না। অনেক কাজ আছে। সে সব আগে কর, তারপর ছুটি পাবে।” ঠাকুরের কথায় স্বামীজীকে রাজি হতে হলো।

১৮৮৬ খ্রিষ্টাব্দে শ্রীরামকৃষ্ণদেবের দেহ ত্যাগের পর স্বামীজী কয়েকজন গুরুভ্রাতাদেরকে নিয়ে বরানগরে একটা ভাঙা বাড়ি ভাড়া নিয়ে মঠ শুরু করলেন। সবাই ঘরবাড়ি ছেড়ে সন্ন্যাসী হলেন জগৎ কল্যাণের নিমিত্তে। খুব অভাব অনটনে দিন কাটত তাদের, কিন্তু ভগবানের চিন্তায় খুব আনন্দে দিন কেটে যেত। খুব ষাধন ভজন করছেন, আর একটাই চিন্তা - কি করে ভারতের কল্যাণ করবেন, লোকের দুঃককষ্ট দূর করবেন। শ্রীরামকৃষ্ণদেব তাঁকে এই কাজটির ভার দিয়ে গেছেন। শুধু ভারতের নয়, যে পথে চলরে সব দেশের মানুষের কল্যাণ হয়, জগৎকে সেই পথ দেখাতে বলে গেছেন।

কিছুদিন পর স্বামীজী বরানগর মঠ থেকে বেরিয়ে নানা তীর্থে ঘুরে বেড়ালেন। পায়ে হেঁটে গোটা ভারতবর্ষ ঘুরে দেখতে রাগলেন। যেখানে আশ্রয় পেতেন, সেখানেই থাকতেন। যা জুটত, তাই খেতেন। কোন কোন দিন খাওয়াই জুটত না।

ভারত তখন পরাধীন, লোকের মনে সাহস নেই, নিজের শক্তির ওপর বিশ্বাস নেই। সাধারণ লোকের দুঃখকষ্টও খুব বেশি। দেশের লোক পেটভরে খেতে পর্যন্ত পারে না। এই সব দেখে স্বামীজীর বুক ফেটে যেত। গরিবের দুঃখ দেখে তিনি অঝোরে কাঁদতেন। ভাবতেন, ভারতবর্ষ একদিন কত বড় ছিল, আর আজ কি হয়েছে! কি করে আবার দেশের উন্নতি হবে, তা ভেবে ভেবে অনেক রাত্রি ঘুম হত না তাঁর।

সারা ভারত ঘুরলেন তিনি, কন্যাকুমারী থেকে মাদ্রাজ। মাদ্রাজে স্বামীজীর অনেক ভক্ত ছিলেন। তাঁদের কাছে জানালেন যে তিনি আমেরিকা যেতে চান, সেখানে শিকাগো শহরে পৃথিবীর নানা দেশ থেকে নানা ধর্মের প্রতিনিধিরা যাবেন, তাঁদের একটি সভা হবে সেখানে। নাম ধর্ম-মহাসভা। স্বামীজীও সভায় যোগ দেবেন। সকলের সামনে হিন্দুধর্মের কথা তেুলে ধরবেন, সকলকে আনন্দ ও শান্তির পথ দেখাবেন।

শ্রীরামকৃষ্ণদেব তাঁকে ধর্মমহাসভায় যাওয়ার ইঙ্গিত দিলেন, ভক্তরা চাঁদা তুলে যাওয়ার খরচ যোগালেন, শিষ্য খেতরির রাজার ব্যবস্থায় শেষে জাহাজে করে ১৮৯৩ খ্রিষ্টাব্দের ৩১ মে স্বামীজী আমেরিকা যাত্রা করলেন।

শিকাগো শহরজুড়ে মেলা বসেছিল, স্বামীজী কয়েকদিন ঘুরে দেখলেন। তারপর ধর্ম-মহাসভায় বক্তৃতা দেবার জন্য নাম লেখাতে গিয়ে শুনলেন আর হবে না, দেরি হয়ে গেছে। সঙ্গে কোন পরিচয় পত্রও ছিল না। সভার এখনো দুমাস দেরি, অতদিন থাকার খরচও নেই, স্বামীজী খুব বিপদে পড়লেন। যেজন্য এতদূর আসা তা বুঝি আর হবে না। থাকবে কোথায়, খাবে কি। একদিন তো স্টেশনে প্রচণ্ড শীতে ভগবানের কৃপায় কোন রকমে প্রাণে বাঁচালেন কাঠের প্যাকিং বাকসের মধ্যে ঢুকে।

এত কষ্ট, এত বিপদ। তবু, তারই ভেতর স্বামীজী সব সময় ভারতের গরিবদের কথা ভেবেছেন। এই অবস্থার ভেতর ভারতে একজন শিষ্যের কাছে চিঠিতে লিখেছিলেন, “ আমি এখানে শতে, বা না খেতে পেয়ে মরেও যেতে পারি। তবু, যাদের জন্যই এখানে এসেছি, তাদের কথা তোমরা ভুলে যেয়ো না। ভারতের তিরিশ কোটি লোকের দুর্দশা দূর করার ভার রইলো তোমাদের ওপর।”

মিসেস হেল নামক একজন ভদ্রমহিলার চেষ্টায় স্বামীজী ধর্মমহাসভায় যোগ দেওয়ার সুযোগ পেলেন। ১৮৯৩ খ্রিষ্টাব্দের ১১ সেপ্টেম্বর শিকাগোতে ধর্ম-মহাসভা শুরু হল। বিভিন্ন ধর্মের প্রতিনিধিরা মঞ্চে বসেছেন, স্বামীজীও রয়েছেন তাদের মধ্যে। যখন তাকে বক্তৃতার সুযোগ দেওয়া হল, তিনি মা সরস্বতীকে স্মরণ করে আরম্ভ করলেন - ‘আমেরিকাবাসী ভগ্নী ও ভ্রাতাগণ!’ স্বামীজীর সম্ধেনে শ্রোতারা আনন্দে মেতে উঠলেন। এই একটি কথাতেই স্বামীজী আমেরিকা জয় করে নিলেন। সকলে বুঝলো, ধার্মিক হতে হলে মানুষকে ভালবাসতে হয়। ধর্মমহাসভা শেষে স্বামীজী আমেরিকা ঘুরে বিভিন্ন জায়গায় বক্তৃতা দিলেন। বহু লোক তাঁর শিষ্য হলেন, সন্ন্যাসীও হলেন।

ভারতের নিন্দা তিনি একদম সইতে পারতেন না।সিংহের মত রুখে দাড়াতেন। এ্কবার এক সাহেব জাহাজে আসতে আসতে তাঁর কাছে ভারতবাসীদের ও হিন্দুধর্মের খুব নিন্দা করছিলেন। স্বামীজী তাকে বুঝিয়ে বলতে চেষ্টা করলেন, কিন্তু তিনি স্বামীজীর কথায় কান দিলেন না। তখন স্বামীজী তাঁর ঘাড়ে হাত রেখে বললেন, “ফের যদি একটি কথা বলেছো, তো তোমাকে জাহাজ থেকে ফেলে দেব।” এই প্রসঙ্গে স্বামীজী পরে বলেছিলেন যে, ধর্ম তো আমাদের মা! মায়ের যদি কেউ নিন্দা করে, তাহলে ছেলেকে চুপ করে তাই শুনতে হবে নাকি?

আমেরিকা থেকে স্বামীজী ইংলণ্ডে যান। সেখানকার খবরের কাগজ লিখল, “ইনি বুদ্ধ ও খ্রীষ্টের মতই একজন মহাপুরুষ।” সেখানেও তার অনেক শিষ্য হলেন। একজনের নাম মিস মার্গারেট নোবেল। পরে তাঁর নাম হয় ভগিনী নিবেদিতা। স্বামীজীর কথায়িএই বিদুষী ভারতকে নিজের দেশ বলে মেনেছিলেন। ভারতের সেবায় জীবন দিয়েছেন।

স্বামীজী ভারতে ফিরলেন, ভারতবাসী তাঁকে বিপুল অভ্যর্থনার সাথে গ্রহণ করলেন। শোভাবাজারে বড় সভা করা হল। স্বমীজী সভায় বললেন, “তোমরা দেশকে ভালবাসো। প্রাণ দিয়ে মানুষকে ভালবাসো। দেশবাসীর সেবা কর। কিছুতেই ভয় পেয়ো না। তোমরা তো বীর! খুব সাহসী হও।” তিনি আরও বললেন, “তোমরা মানুষের মতো মানুষ হও। দেশবাসীর সেবা কর। ভগবানকে যেভাবে সেবা করে, পূজা করে, ঠিক সেইভাবে কর। মনে খুব জোর নিয়ে এসো। সব সময় মনে রাখবে যে তোমরা যা ইচ্ছা করবে, তাই করতে পারবে। শক্তি তোমাদের ভেতরেই আছে। জগতের যা কিছু উন্নতি, সব তো মানুষই করেছে। দেশের জন্য তোমাদের এখন অনেক কাজ করতে হবে। কিছুতেই ভয় পেয়ো না। নির্ভীক হও।”

স্বামীজীর ডাকে সাড়া দিয়ে ততদিনে আরও অনেকে মঠে যোগ দিয়েছেন। স্বামীজী তাঁদের মানসেবার কাজে লাগালেন। বললেন, “ফুল বেলপাতা দিয়ে ভগবানের পূজা করলে যা ফল হয়, ভগবান ভেবে মানুষের সেবা করলেও ঠিক তাই হয়।”

কলকাতায় তখন প্লেগ রোগে বহু লোক মারা যাচ্ছে।সবাই ভয়ে অস্থির, স্বামীজী মঠের সাধুদের নিয়ে প্লেগ রোগীদের সেবায় লেগে গেলেন। বললেন, “সেবা চালিয়ে যাও। টাকার জন্য ভেবো না। দরকার হলে মঠের জমি বিক্রি করে টাকা দেব।”

স্বামী বিবেকানন্দ জগতের হিতার্থে বেলুড় মঠ প্রতিষ্ঠা করেন। সেখানে শ্রীরামকৃষ্ণের পূজো করে স্বামীজী বললেন, “ঠাকুর দীর্ঘকাল এখানে থেকো! লোকের কল্যাণ করো।” বেলুড়মঠ রামকৃষ্ণ মিশনের প্রধান কেন্দ্র হল। মিশনের কাজ হলো শিক্ষার ব্যবস্থা করা, ছেলেদের জীবন গঠন করা। রোগীর সেবা করা। দুভিক্ষ, বন্যা প্রর্ভতি বিপদের সময় মানুষকে সাহায্য করা। যথার্থ ধর্মের প্রচার করা। নানাভাবে মানুষের সেবা করা।

দেশের উন্নতি কি করে হবে, এই ছিল স্বামীজীর চিন্তা। তিনি বলেছেন, “দেশের কল্যাণের জন্য দরকার হলে আমি নরকেও যেতে রাজি আছি।” এতেই বোঝা যায় দেশকে তিনি কতখানি ভালবাসতেন। একদিন বেলুড়মঠে সাঁওতাল কুলিদের খুব লুচি-মণ্ডা-মিঠাই খাওয়ালেন। তারা খুব খুশি হলেন। তাদের আনন্দ দেখে স্বামীজী বলেছিলেন, “ আজ আমার নারায়ণ-সেবা হয়ে গেল।”

শ্রীরামকৃষ্ণদেব স্বামীজীকে জগতের কল্যাণের জন্য কাজ করতে বলে গিয়েছিলেন। স্বামীজী সারা পৃথিবী ঘুরে সেই কাজ করেছেন। এখন ভারতে ও বিদেশে কাজ চালু হয়েছে। ভারতের লোক যেন ঘুমিয়ে ছিল, জেগে উঠেছে। যার পেছনে রয়েছে স্বামী বিবেকানন্দ নামক এক মহাশক্তি।

আজকের এই দিনে স্বামীজী আমাদের মাঝ থেকে স্থুল শরীরে বিদায় নিয়েছিলেন। কিন্তু তিনি আজ বিশ্বব্যাপী। খাঁটি মানষ হবার, মানুষকে ভালবাসার, মানুষকে সেবা করার সঙ্কল্প নিয়ে তাঁকে আজ প্রণাম জানাই :

শ্রীরামকৃষ্ণের বাণী হৃদয়ে ধরিয়া
জনসেবা-রত যিনি জগৎ জুড়িয়া,
ব্যথিতের তরে যাঁর করুণা অপার,
সে বীর বিবেকানন্দে নমি বার বার।

সুমন বিশ্বাস | বাংলাদেশ দর্পণ