সমগ্র যুব সমাজ আজ নৈতিক অবক্ষয়, আদর্শের অবমূল্যায়ন, আমাদের সনাতন কৃষ্টি তথা পূর্বপুরুষের কীর্তির প্রতি অশ্রদ্ধা, আত্মবিশ্বাসহীনতা, গতনুগতিকতায় চলার তীব্র মানসিক প্রবণতা, অন্ধ পাশ্চাত্যানুকরনে বলবতী ইন্দ্রিয়স্পৃহার চরিতার্থতা ইত্যাদি নানা ব্যাধিগ্রস্ত। এছাড়া বহিরাগত বিভিন্ন শক্তি আমাদের অকল্যাণ সাধনে বিশেষ তৎপর হয়ে উঠেছে। ধর্মীয়, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক প্রভৃতি বিভিন্ন স্তরে বহিরাগত নানা শক্তি আমাদেরকে সমূলে ধ্বংস করার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে।

মানুষ দুটি কারণে রোগাক্রান্ত হয়। একটি শারীরিক দুর্বলতা, অপরটি বহিরাগত জীবাণুশক্তির আধিক্য। এর দুইটি কারণই বর্তমানে আমাদের জাতির মধ্যে বিদ্যমান।

আমরা নিজেরা তো দিন দিন শক্তিহীন হয়ে চলেছিই, সেই সাথে পরানুকরণেও ব্যতিব্যস্ত। এর থেকে পরিত্রাণের উপায় কি? জাতির এই দুরারোগ্য ব্যাধি নিরাময় করতে গেলে প্রয়োজন জাতির সহজাত যে প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করা দরকার তার উৎস জাতীয়তাবোধ, মূল্যবোধ যা নির্বাহ করবে আমাদের যুবসমাজ। কারণ আধ্যাত্মিক ও জাতীয় চেতনায় উদ্বুদ্ধ যুবসমাজ সঠিকভাবে অগ্রগামী হলেই আমাদের জাতির এই অধঃপতন রোধ করা সম্ভব হতে পারে।

আমাদের যুবসমাজকে ঠিক যেমন আধ্যাত্মিক জ্ঞানসম্পন্ন হওয়া প্রয়োজন, তেমনি জাতীয়তাবোধে উদ্বুদ্ধ হওয়াটাও খুব আবশ্যক। জাতীয়তাবোধের দ্বারা আমরা আমাদের জাগতিক উন্নয়ন ঘটাতে সক্ষম হব। আমাদের ধর্মীয় চেতনাবোধে জাগ্রত হতে হবে এইজন্য যে, আমরা যদি আধ্যাত্মিক জ্ঞানসম্পন্ন না হই তাহলে আমাদের ব্যক্তি সত্ত্বার বিকাশ সম্ভব নয়। আর ব্যক্তিসত্ত্বার বিকাশ ব্যতীত আমরা জাগতিকভাবে যত উন্নতই হই না কেন সেটা স্থায়ী হবে না। বহির্জগৎ ও অন্তর্জগৎ সব দিক দিয়েই আমাদের উন্নত হওয়ার চেষ্টা করতে হবে। আর এই চেষ্টা সফল করার জন্য জীবনে চাই মহৎ ব্যক্তিদের আদর্শ অনুসরণ।

এক্ষেত্রে আমরা নিদ্বিধায় স্বামী বিবেকানন্দের ভাবাদর্শ অনুসরণ করতে পারি। স্বামী বিবেকানন্দ ছিলেন একজন যুবক সন্ন্যাসী। তিনি নিজে তাঁর জীবনে দেখিয়েছেন একজন যুবক চাইলে কি না করতে পারে। তিনি জীবনটাকে প্রস্ফুটিত করেছিলেন বিদ্যুৎ স্ফুলিঙ্গের মতো। তিনি পৃথিবীতে স্বশরীরে বেশিদিন অবস্থান করেন নাই। মাত্র ৩৯ বৎসর। স্বামী বিবেকানন্দ তাঁর এই স্বল্প পরিসর জীবনে যুবকদের জন্য কয়েকটি উচ্চ আদর্শ স্থাপন করে গেছেন। যুবকদের মধ্যে মানসিক দৃঢ়তা ও আত্মবিশ্বাস আনার জন্য স্বামী বিবেকানন্দের আহ্বান “বিশ্বাস, বিশ্বাস, বিশ্বাস নিজের উপর বিশ্বাস, ঈশ্বরে বিশ্বাস ইহাই উন্নতিলাভের একমাত্র উপায়। যদি তোমার পুরানের ৩৩ কোটি দেবতার এবং বৈদেশিকেরা মধ্যে মধ্যে যে সকল দেবতার আমদানি করেছে, তাহার সব গুলিতেই বিশ্বাস থাকে, কিন্তু নিজের উপর বিশ্বাস না থাকে, তবে তোমার কখনোই মুক্তি হইবে না।”
স্বামীজী আরো বলেছেন, “পৃথিবীর ইতিহাস কয়েকজন আত্মবিশ্বাসী মানুষেরই ইতিহাস। সেই বিশ্বাসই ভেতরের দেবত্বকে জাগ্রত করে।”
আমাদের যুবকদের উদ্দেশ্যে স্বামীজী বলেছেন, “এই পরানুবাদ, পরানুকরণ, পরমুখাপেক্ষা, এই দাসসুলভ দুর্বলতা, এই ঘৃণিত জঘণ্য নিষ্ঠুরতা -এইমাত্র সম্বলে তুমি উচ্চাধিকার লাভ করিবে? ভুলিও না, তোমার বিবাহ, তোমার ধন, তোমার জীবন ইন্দ্রিয় সুখের, তোমার ব্যক্তিগত সুখের জন্য নহে, ভুলিও না তোমার সমাজ সে মহামায়ার ছায়ামাত্র; ভুলিও না নীচু জাতি, মূর্খ, দরিদ্র, অজ্ঞ, মুচি, মেথর তোমার রক্ত, তোমার ভাই। আর বল দিনরাত; হে গৌরিনাথ, হে জগদম্বে, আমার মনুষ্যত্ব দাও, মা, আমার দুর্বলতা, কাপুরুষতা দূর কর, আমায় মানুষ করো।”

স্বামী বিবেকানন্দ মায়ের নিকট প্রার্থনা করতেন “মা আমায় মানুষ করো”। মা স্বামীজীর প্রার্থনা শুনেছিলেন। সত্যিই একজন প্রকৃত মানুষের কথা বলতে গেলে পৃথিবীর ইতিহাসে স্বামী বিবেকানন্দের নাম সকলেরই চোখে পড়বে। তিনি নিজে প্রকৃত মানুষ হয়ে উঠেছিলেন এবং আমাদেরকেও আহ্বান জানিয়েছেন“এসো, মানুষ হও”। 
স্বামীজী বলেছেন “এসো, মানুষ হও।  প্রথমে দুষ্টু পুরুতগুলোকে দূর করে দাও। কারণ এই মস্তিষ্কহীন লোকগুলো কখনও শুধরোবে না। তাদের হৃদয়ের কখনও প্রসার হবে না। শত শত শতাব্দীর কুসংস্কার ও অত্যাচারের ফলে তাদের উদ্ভব; আগে তাদের নির্মূল করো। এসো, মানুষ হও। নিজেদের সংকীর্ণ গর্ত থেকে বেরিয়ে এসে বাইরে গিয়ে দেখো, সব জাতি কেমন উন্নতির পথে চলেছে। তোমরা কি মানুষকে ভালবাসো? তোমরা কি দেশকে ভালবাসো? তাহলে এসো, আমরা ভালো হবার জন্য, উন্নত হবার জন্য প্রাণপণে চেষ্টা করি। পেছনে চেও না, সামনে এগিয়ে যাও।”

আমাদের শক্তিশালী হতে হবে। আমাদের এত অবক্ষয়ের মূলে রয়েছে শক্তিহীনতা। স্বামী বিবেকানন্দ বলেছেন“শক্তিই জীবন, দুর্বলতাই মৃত্যু; শক্তিই ধর্ম, দুর্বলতাই পাপ।”

আমরা শক্তিহীন হওয়ার কারণে যেমন নিজে ভেতরে ভেতরে দুর্বল হয়ে যাচ্ছি, তেমনি বাইরে থেকে আমাদেরকে বিভিন্ন সমস্যা গ্রাস করছে। আমরা শক্তিশালী হলে নিজের সামর্থ সম্পর্কে, নিজের স্বরূপ সম্পর্কে অবগত হতে পারব, আমাদের ব্যক্তিসত্ত্বার বিকাশ ঘটবে, আধ্যাত্মিক উন্নয়ন সাধিত হবে। পাশাপাশি বহিরাগত কোন আসক্তি আমাদেরকে গ্রাস করতে পারবে না, কোন অবক্ষয়জনিত কারণ আমাদেরকে টলাতে পারবে না। সুতরাং আগে আমাদেরতে শক্তিসঞ্চয় করতে হবে।

হে যুবক ভাই ও বন্ধুগণ, আসুন, আমরা স্বামী বিবেকানন্দের ভাবাদর্শে আমাদের জীবন প্রবাহিত করি এবং সকলের সামনে স্বামীজীর ভাবাদর্শ তুলে ধরি। জয় স্বামীজী।

সুমন বিশ্বাস | বাংলাদেশদর্পণ.কম