যাদের রক্তের বিনিময়ে বাংলাদেশ নামক একটি ভূখণ্ড পেয়েছি আমরা, তাদের অবদান কখনও ভুলে যাবার নয়। কেউ পাকিস্তানিদের বিরুদ্ধে সরাসরি সমর যুদ্ধ করে, কেউ সহযোগিতা করে, কেউ সম্ভ্রম হারিয়ে দেশটাকে স্বাধীন করে গেছেন। তবে যারা ২৬ মার্চ রাতের আকস্মিক হামলায় গত হয়েছেন বা অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে গেছেন তাদের অনেকে এখনও সরকারি স্বীকৃতি পাননি। তাদের মধ্যে রয়েছে ঢাকার রমনা কালী মন্দিরের অনেকগুলো পরিবার।

১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ রাতে লাইনে দাঁড় করিয়ে হত্যা করা হয় রমনার কালী মন্দিরে আশ্রয় নেওয়া ৮৫ থেকে ১০০ নিরীহ মানুষকে। তবে স্বাধীনতার ৪৮ বছর পরও তাদের কোনো স্বীকৃতি দেওয়া হয়নি। ওইদিন শহীদ হওয়া ব্যক্তিদের আত্মীয়-স্বজনদের এখন একটাই দাবি শহীদ মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তাদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি। এ বিষয়ে মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয় থেকে বারবার আশ্বাস দেওয়া হলেও তা আজও পূরণ হয়নি।

ওই হত্যাকাণ্ডের অনুসন্ধানে ২০০০ সালের ২৭ মার্চ বিচারপতি কেএম সোবহানকে চেয়ারম্যান করে ছয় সদস্যের ‘রমনা কালীমন্দির ও মা আনন্দময়ী আশ্রম ধ্বংস ও হত্যাযজ্ঞ গণতদন্ত কমিশন’ গঠিত হয়। পাঁচ মাস ধরে কমিশন নিহত পরিবারের সদস্য, আহতদেরসহ শতাধিক ব্যক্তির সাক্ষ্য লিপিবদ্ধ করে। তাদের দেওয়া প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, ২৬ মার্চ দিবাগত রাত ২টার দিকে মন্দির ও আশ্রম ঘেরাও করে পাকিস্তানিরা। সার্চলাইটের আলোয় গোটা এলাকা আলোকিত হয়ে যায়। শুরু হয় গোলাবর্ষণ। আচমকা এ হামলায় প্রাণভয়ে শুরু হয় দৌঁড়াদৌঁড়ি। মেয়েরা শাঁখা খুলে মুছে ফেলেন সিঁদুর। অনেকে লুকিয়ে পড়েন মন্দির ও আশ্রমের বিভিন্ন স্থানে। তবে সবাইকে খুঁজে বের করে সেনারা মন্দিরের সামনে এনে দাঁড় করায়। এরপর গুলি চালিয়ে হত্যা করে ৮৫ থেকে ১০০ জনকে। ভোর ৪টার দিকে পাকিস্তানি বাহিনী রমনা ত্যাগের সময় বেশ কয়েকজন তরুণীকে ধরে নিয়ে যায়, যাদের আর ফিরে পাওয়া যায়নি।

কমিটির প্রতিবেদনে ৫০ জনের নাম উল্লেখ করা আছে। এদের মধ্যে রয়েছেন- স্বামী পরমান্দ গিরি, বরণ রাম কানু, রঘুলাল দাস, ধীরেন লাল ঘোষ, শ্রীমতি লক্ষ্মী চৌহান, হীরালাল পাশী, বাবুলাল, সূর্য, রাম গোপাল, সন্তোষ ঘোষ, সুনীল ঘোষ, মোহন দাস, রাম বিলাস দাস, জয়ন্ত চক্রবর্তী, বিরাজ কুমার, ভোলা পাশী, গণেশচন্দ্র দাস প্রমুখ।

ওই ভয়াবহ হামলায় মৃত্যুর হাত থেকে বেঁচে যান শংকর লাল ঘোষ, দিলীপ দাস, বেলি রানীসহ কয়েকজন। এদের মধ্যে শংকর লাল ঘোষ বলেন, ‘তখন আশ্রমে ৭৫টির মতো পরিবার বসবাস করতো। একেকজনের একেক পেশা। ২৬ মার্চ সকালে একজন কর্নেল এসে আমাদের চলে যেতে বলেন। অনেকে চলেও যায়। কিন্তু দুপুর ২টায় কারফিউ জারি হওয়ায় সবাই আটকা পড়ে। রাত ২টার দিকে কালীমন্দিরের পুরোহিত পরমানন্দ গিরিকে পাকিস্তানিরা জোর করে কালেমা পড়িয়ে বেয়নেট দিয়ে পেট চিরে এবং গুলি চালিয়ে হত্যা করে। আমার হাতেও গুলি লাগে। মৃত ভেবে আমাকে তারা রেখে যায়।’

তিনি আরও বলেন, ‘ভয়াবহ হামলার শিকার হয়েও সরকারের পক্ষ থেকে কোনোরকম সহযোগিতা পাইনি আজও। আমাদের দাবি, পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হোক।’

মন্দির ও আশ্রমে নিহতদের ‘শহীদ মুক্তিযোদ্ধা’ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার দাবি জানিয়ে আসছে তাদের পরিবারগুলো। বিভিন্ন সময় তারা সরকারের কাছে স্বীকৃতি ও আর্থিক সহায়তারও আবেদন জানিয়েছেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সময়ে একবার এককালীন অনুদান দেওয়া হয়েছিল। তবে কোনো নিয়মিত ভাতা পাননি তারা। ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর একটি কমিটি প্রতিবছর মন্দির ও আশ্রমে অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। এখন ৬১টি পরিবারের খোঁজ কেবল ওই কমিটির কাছেই আছে। তাদের উদ্যোগে ২০০১ সালে মন্দিরের সামনে নির্মাণ করা হয় একটি স্মৃতিফলক, যেখানে কেবল ৬১ জনের নাম আছে।

আরও পড়ুন: হিন্দুরাও সরকারি খরচে ভারতে তীর্থ ভ্রমণের সুযোগ পাচ্ছেন

এই কমিটির সাধারণ সম্পাদক বিপুল রায় বাংলা একাডেমির চুক্তিভিত্তিক কর্মী। ওই রাতে তার দাদা বাদল চন্দ্র রায় এবং ভাই ত্রিদিব কুমার রায় শহীদ হন। বিপুল রায় বলেন, ‘মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এ হত্যাকাণ্ডের উল্লেখ খুব একটা দেখা যায় না। আমাদের তিনটি দাবির একটি শহীদদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দেওয়া। অন্য দুটি দাবি হচ্ছে শহীদ পরিবারের সদস্যদের পুনর্বাসন এবং আর্থিক সহায়তা প্রদান। কিন্তু সরকারের পক্ষ আজ পর্যন্ত কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি।’

শহীদ বরণ রাম কানুর ছেলে স্বপন কুমার কানু বলেন, ‘আমাদের একটাই দাবি। সেদিন রাতে গত হওয়া শহীদদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি দেওয়া হোক। যাদের রক্তের বিনিময়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে তারা অবহেলিত থাকতে পারে না। শহীদ পরিবারের সদস্যদের পুনর্বাসন এবং আর্থিক সহায়তা প্রদানের বিষয়ে অনেক দিন থেকে কাজ চললেও সম্পন্ন হবে কিনা তার কোন নিশ্চয়তা নেই। মুজিব বর্ষে যাতে এই প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হয় সে ব্যাপারে জোর দাবি জানাচ্ছি।’