আপনারা নিজেরা বা নিজেদের পরিবার অথবা আত্মীয়স্বজনের চিকিৎসায় পারতপক্ষে কখনও “অনেক রোগী, রোগীর লাইন, সিরিয়াল পেতে ১ মাস লাগে” ধরনের সিনিয়র চিকিৎসকদের শরণাপন্ন হবেন না।

আমার ক্ষুদ্র অভিজ্ঞতা ও ক্ষুদ্রতর জ্ঞানে যেটুকু বুঝি তা হলো আমাদের দেশের একটি বড় সংখ্যার জ্যেষ্ঠ চিকিৎসকরাই সুস্থ প্র‍ক্রিয়ায় রোগীর চিকিৎসা করেন না। উনাদের জ্ঞান ও দক্ষতা নিয়ে প্রশ্ন নেই, কিন্তু সহজ বাংলায় বলতে গেলে উনারা(অধিকাংশ) যেভাবে রোগী দেখেন সেভাবে রোগী দেখার কোন নিয়মই নেই, এমনকি গরু ছাগলও এভাবে দেখা ঠিক নয়। উনাদের বড় একটি অংশেরই মানসিক বিকৃতি ঘটেছে, ন্যূনতম ভব্যতাবোধও উনাদের অনেকের মাঝে এখন আর নেই।

ভেবে দেখুন আপনি যদি এই চিন্তা করে ভালো চিকিৎসক নির্ণয় করেন যে অমুক চিকিৎসকের কাছে প্রচুর রোগী, উনার সাক্ষাৎকারের অনুমতি পেতেই ১ মাস সময় লাগে,এমন একজন চিকিৎসক যদি দিনে ১০০ রোগী দেখেন আপনি কি মনে করেন উনি কারও কথাই ঠিকমতো শোনেন? শোনেন না। উনার কাছে রোগীমাত্রই একটি সংখ্যা মাত্র।

এই যে এন্ডোস্কোপি করতে গিয়ে ঢাকায় যে ঘটনাটি ঘটল, উক্ত চিকিৎসক আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ব্যক্তি, উনার ঝুলিতে আছে প্রায় ৪৮ হাজার এন্ডোস্কোপি করার অভিজ্ঞতা, প্রায় ৪০০ আন্তর্জাতিক গবেষণাপত্র, চিকিৎসা বিজ্ঞান নিয়ে লেখা ৬ টি আন্তর্জাতিক আন্তর্জাতিক বই, অর্থাৎ উনার জ্ঞান বা দক্ষতা নিয়ে সন্দেহ নেই। তাহলে সমস্যাটা কোথায়? সমস্যাটা এখানেই যে উনাদের কাছে এন্ডোস্কোপি একটা সংখ্যা মাত্র, একটি রোগীর এন্ডোস্কোপি বা অন্য যে কোন চিকিৎসা করার আগে তার সাথে নিজে বসে বিস্তারিত কথা বলা উচিত, তাদেরকে এই চিকিৎসায় সম্ভাব্য জটিলতা তার হার যতই কম হোক না কেন তা বুঝিয়ে বলা উচিৎ এই বোধটা আর নেই। যে চিকিৎসক ভোর থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত রোগী দেখেন তার কাছে কীভাবে আপনি বা আমি ভালো চিকিৎসা আশা করব? তিনি তো রোগীর চাপে ইতিমধ্যে নিজেই মানসিক রোগী আর একজন মানসিক রোগীর কাছ থেকে ভালো ব্যবহার ই বা কীভাবে আশা করবেন?

আমি তাই ব্যক্তিগতভাবে আমাদের আগের প্রজন্মের সিনিয়র চিকিৎসকদের অধিকাংশকেই সহজ বাংলায় “বিশ্বাস করিনা”। তাদের অধিকাংশই যে পদ্ধতিতে চিকিৎসা করেন, কেউ কেউ একই সাথে গরুর খোয়াড়ের মতো চেম্বারে কয়েকজন রোগী ঢুকিয়ে প্রাইভেসির বালাই না করেই একসাথে দেখেন, কেউ কেউ রোগীর সাথে কোন কথা না বলেই মিনিটখানেকের মধ্যে সাক্ষাৎকার শেষ করে দেন, অথচ এই উনারাই আমাদেরকে ছাত্র অবস্থায় ১ ঘন্টার History Taking+ History Writing এ ১ মুহুর্তও চুল পরিমাণ ভুল হলেও ফেল করিয়ে দেন, অকথ্য ব্যবহার করেন, আমাদের জীবনটা নরক বানিয়ে দেন। কিন্তু নিজেদের বাস্তব জীবনে উনারা  নিজেরাই এগুলোর ধার ধারেন না।

অপরদিকে দুঃখজনক হলেও সত্য যেসব চিকিৎসক বেশ সময় নিয়ে রোগী দেখেন, রোগীদের সব বুঝিয়ে বলেন তাদের কাছে রোগীরা যান না বা যেতে চান না। তাদের চেম্বার থাকে ফাঁকা। বাস্তব অভিজ্ঞতায় এরকম অনেক শ্রদ্ধেয় চিকিৎসককে চিনি। অনেক রোগী এমন ধারণাও পোষণ করেন যে “বড় ডাক্তার হলে এতক্ষণ ধরে দেখত না” বা “বড় ডাক্তার হলে রোগ ধরতে এতক্ষণ লাগে নাকি”! এমনকি এভাবেও বলতে শুনেছি “বড় ডাক্তার হলে এত সুন্দর করে কথা বলত নাকি!”।


অবশ্যই চিকিৎসা বিজ্ঞানে চিকিৎসা জনিত পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। ভারতে গত কয়দিন আগে দঙ্গল অভিনেত্রীও মারা গেলেন ওষুধের পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায়। চিকিৎসা প্রক্রিয়ার পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায় মৃত্যু এক বিষয়, কিন্তু চিকিৎসা শুরু করার আগে রোগীকে এবং তার স্বজনদের সেই প্রক্রিয়ায় কী কী হতে পারে, তার ভালো এবং খারাপ দিকগুলো কী কী তা না জানিয়ে নিজেকেই সর্বেসর্বা ভেবে চিকিৎসা শুরু করে দেয়া নিতান্তই অপরাধ, শাস্তিযোগ্য অপরাধ। 

একজন রোগী কেবল ওষুধ লেখার জন্য অর্থ খরচ করেন না, চিকিৎসা সংক্রান্ত যাবতীয় বিষয়াবলী যতক্ষণ তিনি না বুঝেন ততক্ষণ তাকে ধৈর্য ধরে বুঝানোর জন্যও তার দেয়া সম্মানি প্রযোজ্য। যে সকল চিকিৎসক এত পরিমাণে রোগী দেখেন যে রোগীকে বুঝানোর সময় ই তাদের নেই সেই সকল চিকিৎসককে বয়কট করুন। তাদের রোগীর দীর্ঘ সারি দেখে প্রলুব্ধ হবেন না।

অস্ত্রোপচার করতে হলে খুব বড় বয়স্ক চিকিৎসক খুঁজবেন না। তাদের অধিকাংশ ই এই ঢাকার চিকিৎসক মহোদয়ের মতোই অস্ত্রোপচারের আগে রোগীর সার্বিক পরিস্থিতির খবর নেন না, নেবার সময় ই তার নেই। আপনার বড় নামের প্রতি অবারিত মোহ তার সীমাহীন লোভের জ্বালানি হয়ে দাড়িয়েছে, বড় অধ্যাপক হয়েও সামান্য জ্বর কাশির রোগীও তিনি কনিষ্ঠ চিকিৎসকদের কাছে না পাঠিয়ে ভোর হতে রাত অব্দি রোগী দেখেন। সর্দির রোগীর মন ভরে অধ্যাপক দেখিয়ে, অধাপকের পকেট ভরে সর্দির রোগী দেখে মধ্যরাতে বাসায় ফিরে। এই দুষ্টচক্রে পড়ে অবহেলিত হতে থাকেন “সময় নিয়ে দেখা প্রয়োজন ছিল” এমন জটিল রোগীরা। আপনি  বরং সেসব চিকিৎসকদের কাছে যান যারা সময় নিয়ে সুস্থ মাথায় রোগী দেখেন, যারা নিজেদের পর্যায়ের রোগী ব্যতিত নিম্নস্তরের রোগের রোগীদের পাঠিয়ে দেন কনিষ্ঠ চিকিৎসকদের কাছে যার ফলে নিজে সময় দিয়ে জটিল রোগীগুলোকে মনোযোগ দিয়ে দেখতে পারেন, যারা তথাকথিত “অনেক বড় ডাক্তার” নন বরং যারা সুস্থ প্রক্রিয়ায় স্বল্প সংখ্যক রোগী দেখা “যথাযথ ডাক্তার”। অস্ত্রোপচারের সময় খোঁজ নিন যিনি অস্ত্রোপচার করবেন তার সাথে আবেদনবিদ( এনেস্থিসিওলজিস্ট) কে আছেন, শুধু বড় শল্যবিদ হলেই হবেনা, অস্ত্রোপচার সফল হবার জন্য আবশ্যক অভিজ্ঞ আবেদনবিদেরও। আজ ঢাকার সেই এন্ডোস্কোপির বা খতনার ঘটনা কিন্তু ঘটেছে আবেদনবিদ না থাকার কারণেই।

যে সব “বিখ্যাত(!)” শল্যবিদ অভিজ্ঞ আবেদনবিদ ছাড়াই শল্য চিকিৎসা করেন পুরো সম্মানিটিই নিজের পকেটে ঢুকানোর জন্য তাদের বর্জন করুন। তথাকথিত বড় চিকিৎসকের পিছনে ঘুরে অর্থ অপচয় করবেন না, তরুণ প্রজন্মের এবং তাদের “ইমিডিয়েট সিনিয়র” প্রজন্মের যে সকল চিকিৎসক সময় নিয়ে, সুস্থ মাথায় রোগী দেখেন এবং রোগীদের সব বুঝিয়ে বলেন, পরামর্শ দেন তাদের কাছে যান। এতে আপনিও ভালো চিকিৎসা ও পরামর্শ পাবেন, এ ধরনের সুস্থ, মানবিক চিকিৎসা করতে উনারাও প্রেরণা পাবেন। এ ধরনের চিকিৎসকদের এড়িয়ে গিয়ে কেবল তথাকথিত নামের মোহে দেশের সুস্থবোধ সম্পন্ন চিকিৎসকদের আগ্রহ নষ্ট করে ফেলবেন না। মনে রাখবেন পসার করা চিকিৎসক মানেই ভালো চিকিৎসক নন।

চিকিৎসা প্রক্রিয়ায় ওষুধ দেয়া বা অস্ত্রোপচার করা একটি অংশ মাত্র, ওষুধ দেয়া ই বা অস্ত্রোপচার করা ই চিকিৎসার একমাত্র অংশ নয়। চিকিৎসকের কর্তৃক রোগীকে তার রোগ সম্পর্কে যথেষ্ট সময় নিয়ে বুঝিয়ে বলা, সেই রোগের চিকিৎসার ভালো ও খারাপ দিকগুলো বিস্তারিত বলা, সেই রোগের বিকল্প আর কী কী চিকিৎসা রয়েছে সেগুলোও উপস্থাপন করা, হাসপাতালের দারোয়ান থেকে শুরু করে প্রতিটি কর্মচারীর সুন্দর আচরণ, সাহায্যমূলক কর্মকাণ্ড এবং সেবিকাদের মিষ্টি ব্যবহার এই সবকিছুই চিকিৎসার অন্তর্গত। পর্যাপ্ত ভালো বেতন না দিলে এই ধরনের কর্মচারী নিয়োগ দেয়া সম্ভব নয় এবং অধিকাংশ হাসপাতাল ই নিজেদের লাভের জন্য নিম্নবেতনে অযোগ্য কর্মচারী নিয়োগ দেন বলে রোগীরা এসব চিকিৎসাসেবা হতে বঞ্চিত হন।  যে সকল হাসপাতাল ও চিকিৎসক এই প্রতিটি বিষয়কে গুরুত্ব দেন না তাদের বর্জন করুন। যে সকল চিকিৎসক দিনরাত রোগী দেখেন তারা 

রোগীদের সাথে প্রতারণা করছেন এই সহজ সত্যটা বুঝতে শিখুন। একজন বিশেষায়িত পেশার সাথে জড়িত মানুষ এভাবে দিনরাত কাজ করলে তার বুদ্ধিবৃত্তিক চেতনাশক্তি হ্রাস পাবে, তিনি কোনভাবেই পূর্ণ মানসিক শক্তি নিয়ে আপনাকে সেবা দিতে পারবেন না। তাই নামের পিছনে না ছুটে নিজে ভালো থাকুন, এসব প্রতারকদের প্রতারণার লাগাম টেনে ধরুন এবং ভালো চিকিৎসকদের উৎসাহিত করুন।

(এই লেখাটি সরকারি হাসপাতালের বহির্বিভাগের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়, সেখানে রোগীর সংখ্যা নির্ধারণের ক্ষমতা চিকিৎসকের নেই।)

স্বাস্থ্য ডেস্ক, বাংলাদেশ দর্পণ