'মনসা' শব্দটি বিশ্লেষণ করলে অর্থ দাঁড়ায় ‘মনে চিন্তন’। আমাদের মনের মধ্যে বিষ থাকতে পারে, সেই বিষ অবশ্যই মনকে বিষাক্ত করে এবং চিন্তার খোরাক যোগায়। মনকে বিষ মুক্ত অর্থাৎ চিন্তা মুক্ত করতেই মনসা পুজা! মনসা মন্ত্র মনকে ঊর্ধ্বগামী করতে পারে।
মন যদি কোনো কারনে বিষক্রিয়ায় জর্জরিত হয় তবে সমগ্র দেহই বিষাক্ত হয়ে যাবে। আর এই অবস্থা থেকে পরিত্রাণের জন্য আর্যঋষিগন মনসা দেবীকে বিষহরী দেবী রুপে দেখিয়েছেন।
সাপের দাঁতে বিষ আছে কিন্তু নিজে যখন খায়, তাতে কোনো বিষ লাগে না। কিন্তু হিংসায় কিংবা আত্মরক্ষার্থে যখন দংশন করে তখন দংশিত স্থানে বিষ ছড়ায়। তাই মনে বিষ হলে হিংসা, ক্রোধ, লোভ এসব দূরীকরনের নিমিত্তে মনসা পূজা করা হয়। অন্যভাবে বললে, আমরা নিজেরা অনেক সময় চিন্তা থেকে মুক্তি পেতে পারিনা। তবে চিন্তা যাতে নিজের কিংবা অন্যের খারাপের কারন না হয়, সেই শিক্ষাই দিয়েছে দেবী মনসা।
মনসামঙ্গল একটি কাব্যগ্রন্থ।মধ্যযুগীয় বাংলা সাহিত্যের মঙ্গলকাব্য ধারার অন্যতম প্রাচীন কাব্য।মনসামঙ্গল কাব্যের প্রধান দেবতা সর্পদেবী মনসা।মনসা মঙ্গল একটি আখ্যান ধর্মী কাব্য।এই কাব্যের প্রধান আখ্যানটি আবর্তিত হয়েছে মর্ত্যলোকে মনসার পূজা প্রসারের প্রয়াসকে কেন্দ্র করে।
হিন্দু ধর্মগ্রন্থে অথর্ববেদে সর্পদেবী হিসাবে মনসার কথা উল্লেখ রয়েছে।পুরানে মনসাকে ঋষি কাশ্যপ ও নাগ জননী কদ্রুর কন্যা বলা হয়েছে।কাব্যের মূল উপজীব্য হল চাঁদ সওদাগরের উপর দেবী মনসার অত্যাচার।মনসা মর্তে পূজিত হতে চাঁদ সওদাগরকে বাধ্য করতে চেয়েছিল।কিন্তু চাঁদ সওদাগর ছিল শিব ভক্ত।তাই সে মনসাকে পূজা করতে অস্বীকার করেছিল।পরিনামে মনসা চাঁদ সওদাগরের ৬ পুত্রকে সর্পাঘাতে হত্যা করে।চাঁদের সপ্তম পুত্র লখিন্দরের সর্পাঘাতে মৃত্যু ও পুত্রবধূর বেহুলার আত্মত্যাগ এই উপাখ্যানের প্রধান উপজীব্য।মনসা মঙ্গল কাব্যে বেহুলা একটি কিংবদন্তি চরিত্র।শাশ্বত স্বামী ভক্তির এক অসাধারণ চিত্র।সতীত্ব রক্ষায় বেহুলা এক অসাধারণ চারিত্রিক দৃঢ়তার পরিচয় দিয়েছিল।বেহুলার নির্ভীক তেজস্বিতা এবং আত্মশক্তির কাছে দৈব শক্তি পরাজিত হয়েছিল।নারীত্বের মহিমায় বেহুলা সীতা-সাবিত্রি দময়ন্তির মতোই বাংলা সাহিত্যের এক উজ্জ্বল চরিত্র।বাংলার ঘরে ঘরে আজো বঙ্গ ললনারা বেহুলার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের অনুসারী।এই কাব্য লোক শিক্ষার আধার রূপে আজও সমান ভাবে গ্রামেগঞ্জে সমাদৃত।খ্রিস্টীয় ১৪শ শতাব্দী নাগাদ মনসা বিবাহ ও সন্তান ধারনের শক্তিরূপে প্রজননের দেবী হিসাবে চিন্হিত হয়।সর্প দংশনের হাত থেকে রক্ষা পেতে এবং ঐশ্বর্য লাভের উদ্দেশ্যে মানুষ তার পূজা করে থাকে।
মনসামঙ্গল কাব্যে বেহুলা এবং চাঁদ সওদাগর যে কোন কাল্পনিক কাহিনী ছিল না তার প্রমান পাওয়া যায়।বেহুলার বাসর ঘর বাংলাদেশের বগুড়া সদরের গোকুল নামক স্থানে অবস্থিত।বগুড়া শহর হতে প্রায় ১১কিঃমিঃ উত্তরে বাসর ঘরের অস্তিত্ব রয়েছে।হাজার হাজার মানুষ প্রতিদিন এই বাসর ঘর দেখতে যান।এই অঞ্চলে করতোয়া নদী এখন শীর্নকায় কিন্তু অতীতে বিশালাকার ছিল।সেই নদী দিয়েই চাঁদ সওদাগরের সপ্তডিঙা মধুকর চলাচল করতো বলে মনে করা হয়।সেখানে একটি মাটির ঢিবি ঠিক নৌকার আকৃতির মত আজও সংরক্ষিত রয়েছে।মনে করা হয় মাটির নিচে নৌকায় স্বর্ণ মুদ্রা ধন সম্পদ রক্ষিত।কিন্ত কেউ এখনো মাটি খুঁড়ে দেখার সাহস করতে পারেনি।সেখানে একটি কূপ এখনো সংরক্ষিত আছে।কথিত আছে এই কূপের জল দিয়ে বেহুলা স্নান করতো।