আজ পবিত্র নীল ষষ্ঠী। অন্যান্য বছরের ন্যায় চারিদিকে করোনা ভাইরাস হেতু নিস্তব্ধ বাতাবরণে এই পবিত্র পূজা, আচার সহ পালিত হবে না - এ এক রূঢ় সত্য। তাই, প্রত্যেক গৃহই হয়ে উঠুক দেবস্থান, গৃহের অভ্যন্তরে পূজিত হোন ঈশ্বর। অনন্ত বিষ্ণু থেকে শান্ত শ্রীকৃষ্ণ - নিরাকার থেকে আকার যেখানে একাঙ্গীভূত হয়ে যায় - ভক্তের হৃদয়ের আকুতিতে - তাই হিন্দু ধর্ম শ্রেষ্ঠ - ঋষি রাজনারায়ণ বসু থেকে বঙ্কিমচন্দ্র থেকে হীরেন্দ্রনাথ দত্ত প্রভৃতি বহু মনীষী এ সম্পর্কে বিস্তৃত ব্যাখ্যা করেছেন।

নীলপূজা বা নীলষষ্ঠী হল বাংলার হিন্দুসমাজের এক লৌকিক উৎসব, যা মূলত শিব-দুর্গার বিবাহ বা শিবের বিয়ে নামে পরিচিত। বাঙালি গৃহিণীরা নিজের সন্তান এর মঙ্গল কামনায় নীরোগ সুস্থ জীবন কামনা করে নীলষষ্ঠী  ব্রত পালন করে সাধারণত চৈত্রসংক্রান্তির চড়ক উৎসবের আগের দিন নীলপূজা অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে।

নীলসন্ন্যাসীরা ও শিব-দুর্গার সঙেরা পূজার সময়ে নীলকে সুসজ্জিত করে গীতিবাদ্য সহযোগে বাড়ি বাড়ি ঘোরান এবং ভিক্ষা সংগ্রহ করেন। নীলের গানকে বলা হয় অষ্টক গান। ঐদিন সন্ধ্যাবেলায় সন্তানবতী হিন্দু রমণীরা সন্তানের কল্যাণার্থে প্রদীপ জ্বালিয়ে শিবপূজা করে সারাদিনের উপবাস ভঙ্গ করেন।

নিম বা বেল কাঠ থেকে নীলের মূর্তি তৈরি হয়। চৈত্রসংক্রান্তির বেশ আগেই নীলকে মণ্ডপ থেকে নীচে নামানো হয়। নীলপূজার আগের দিন অধিবাস; অধিক রাত্রে হয় হাজরা পূজা অর্থাৎ বিয়ে উপলক্ষে সকল দেবতাকে আমন্ত্রণ করা। হাজরা পূজায় শিবের চেলা বা ভূত-প্রেতের দেবতাকে পোড়া শোল মাছের ভোগ দেওয়া হয়। পরদিন নীলপূজার সময় নীলকে গঙ্গাজলে স্নান করিয়ে নতুন লালশালু কাপড় পরিয়ে অন্ততপক্ষে সাতটি বাড়িতে নীলকে ঘোরানো হয়।

নীলসন্ন্যাসীরা একইরকম লাল কাপড় পরে পাগড়ি মাথায়, গলায় রুদ্রাক্ষমালা ও হাতে ত্রিশূল নিয়ে নীলকে সঙ্গে করে এই মিছিল করেন। এদের দলপতিকে বলা হয় বালা। সাথে থাকে ঢাক-ঢোল, বাঁশী বাজনদারের দল এবং কাল্পনিক শিব-দুর্গার সাজে সঙেরা। গৃহস্থ মহিলারা উঠানে আল্পনা দিয়ে নীলকে আহ্বান করে বরাসনে বসিয়ে তার মাথায় তেলসিঁদুর পরিয়ে দেন। এরপর নীলের গান শুরু হয়:

"শুন সবে মন দিয়ে হইবে শিবের বিয়ে
      কৈলাসেতে হবে অধিবাস।
(ও) তাতে নারদ করে আনাগোনা কৈলাসে বিয়ার ঘটনা
       বাজে কাঁসী বাঁশী, মোহন বাঁশরী।"

"(ও) নারদ চলল গিরি রাজের গৃহেতে।
আর একদিনেতে শূলপাণি, নারদকে বলেন বাণী
শুনো নারদ শুনো আমার সাধ,
আমি দুই পাশে দুই বালিশ দিয়ে, মধ্যিখানে থাকি শুয়ে
উশিপুসি করে কাটাই রাত।।
(ও) নারদ চললো গিরি রাজের গৃহেতে।।
আর ওই শিব কয় কৈলাসে যেয়ে, দেখে এসেছি মেয়ে
শীঘ্র করো বিয়ের আয়োজন,
(ও) নারদ চললো গিরি রাজের গৃহেতে।।
চলিলেন নারদ মুনি, চলিলেন নারদ ধনি
উপনীত গিরি পুরে যেয়ে।
কইলেন মেনকা রানী, আইলেন নারদ মুনি
দেখা পেয়ে এল মুনির ঠাঁই।।
(ও) নারদ চললো গিরি রাজের গৃহেতে।।
শোনো ওগো গিরি রাজা, হইবা আমার আজা
জামাই তোমার হবে দিগম্বর।।"

বিয়ের ঘটক ভাগিনেয় নারদ মুনির কাছে শিব আর্তি জানান,

"ভাইগনা যদি উপকারী হও।
তবে বিয়া দিয়া আমার প্রাণ বাঁচাও।।"

বিয়ের পর নীলের গানে থাকে সংসারী হর-পার্বতীর কথা, শিবের কৃষিকাজ, গৌরীর শাঁখা পরা প্রভৃতি এবং ভিখারি শিবের সঙ্গে অন্নপূর্ণা শিবানীর দ্বান্দ্বিক সহাবস্থানের কাহিনি। গানের প্রথম অংশ দলপতি বালারা এবং পরবর্তী অংশ অন্য নীলসন্ন্যাসীরা গেয়ে থাকেন।

গানের শেষে গৃহস্থরা সন্ন্যাসীদের চাল-পয়সা, ফল প্রভৃতি ভিক্ষাস্বরূপ দেয়।[২]

ঐদিন সন্তানবতী হিন্দু নারীরা সারাদিন উপবাস রেখে সন্তানের আয়ু বৃদ্ধির কামনায় 'নীল ষষ্ঠী'র ব্রত করে। নীলপূজার পর সন্ধ্যাবেলায় শিবমন্দিরে বাতি দিয়ে জলগ্রহণ করে।