মাণিক রক্ষিত ::

এ বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলে ঐতিহ্যবাহী সরস্বতী পূজা দু’টি আলোচিত ও ঐতিহাসিক ঘটনার জন্ম দিয়েছে। এক. আন্দোলনের মাধ্যমে পূজার দিনে সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচন পেছানো হয়েছে। দুই. অব্রাহ্মণ পুরোহিতের মাধ্যমে সরস্বতী দেবীর পূজা সামাজিক মাধ্যমে আলোড়ন তুলেছে। দ্বিতীয় প্রসঙ্গে মানুষের পক্ষে-বিপক্ষে মতামত রয়েছে। এটাই স্বাভাবিক। 

এবার জগন্নাথ হলে মোট ৭১টি মণ্ডপে সরস্বতী পূজা হয়েছে বলে জানা গেছে। সাধারণত ব্রাহ্মণবংশীয় পুরোহিতই পূজা করে থাকেন। তবে এবার দু’টি বিভাগের পূজায় পুরোহিত ছিলেন অব্রাহ্মণ। রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগ আয়োজিত পূজায় পৌরহিত্য করেন একই বিভাগের ছাত্র সন্তোষ রায় অজয়। আর সমুদ্রবিজ্ঞান বিভাগে পূজা করেছেন মনোবিজ্ঞান বিভাগের দ্বিতীয় বর্ষের বিদ্যার্থী তমা অধিকারী। সঙ্গত কারণেই প্রশ্ন উঠেছে, অব্রাহ্মণ পুরুষ কিংবা নারী কি পূজায় পৌরহিত্য করতে পারেন?

এ প্রশ্নের উত্তর সন্ধানে প্রথমে জানা দরকার, ব্রাহ্মণ কে আর পুরোহিত কে? প্রথমত, বেদ ও বেদসম্মত শাস্ত্রই সনাতন ধর্মে সিদ্ধান্ত গ্রহণে শিরোধার্য। কোনো মানবরচিত শাস্ত্রের নিরিখে ধর্মীয় বিধান বিচার করলে অনর্থ ঘটবেই। গুরুত্বের পর্যায়ক্রমে বেদ-স্মৃতি-সদাচার-বিবেকের বাণী বিচার করে সিদ্ধান্ত নেওয়াটাই ধর্মের বিধান। 

বেদ অনুযায়ী, যার ব্রহ্মজ্ঞান আছে তিনিই ব্রাহ্মণ। যার ব্রহ্মজ্ঞান নেই, তিনি ব্রাহ্মণ নন। পবিত্র গীতায় প্রদত্ত সংজ্ঞা অনুযায়ী, যার মাঝে নয়টি বিশেষ গুণ আছে, তিনিই ব্রাহ্মণ। নয়টি গুণ হলো- চিত্তনিবৃত্তি, ইন্দ্রিয়সংযম, তপস্যা, কায়িক-বাচিক-মানসিক শুচিতা, ক্ষমা, সরলতা, স্বাধ্যায়, তত্ত্বানুভব ও আস্তিক্য। এই কয়টি স্বভাবজাত গুণ-কর্ম যার আছে তিনিই ব্রাহ্মণ। যার মধ্যে এসব গুণ-কর্ম নেই, তিনি ব্রাহ্মণ নন। এটাই শাস্ত্রের সিদ্ধান্ত। 

ব্রাহ্মণরা যজ্ঞোপবীত বা পৈতা ধারণ করেন। এই পৈতায় নয়টি সুতা থাকে। মূলত এগুলো নয়টি গুণের প্রতীক। অর্থাৎ একজন ব্রাহ্মণ নয়টি গুণ ধারণ করেন। পৈতাধারী কেউ উল্লেখিত গুণের অধিকারী না হলে শাস্ত্রানুযায়ী তিনি ব্রাহ্মণ পদবাচ্য নন। পৈতা আছে কিন্তু গুণ নেই এমন ব্যক্তির যজ্ঞ, আর পৈতা নেই কিন্তু গুণ আছে এমন ব্যক্তির যজ্ঞ – এর মধ্যে দেবতার কাছে কোনটি বেশি গ্রহণযোগ্য? পৈতার সুতার মূল্য বেশি, নাকি একজন মানুষের অর্জিত গুণের মূল্য বেশি? সে বিবেচনার ভার দেবতার ওপরেই ছেড়ে দেওয়া ভালো। এটা নিয়ে বাক-বিতণ্ডা করলেও কিন্তু ব্যাপারটা অব্রাহ্মণসুলভ কাজ হয়ে যাবে। কারণ, ইন্দ্রিয়সংযম, ক্ষমা, সরলতা ও প্রকৃত তত্ত্ব অনুভব করা ব্রাহ্মণেরই গুণ।

দেবতা যেমন সবার, তেমনি দেবতার সেবা-পূজা করার অধিকারও সবার। পবন দেবতা (বায়ু), বরুণ দেবতা (জল), বসুমতী দেবী (মাটি), সূর্যদেব, অগ্নিদেব, বৃক্ষ-ওষধি, মাতা গঙ্গা (নদী), সরস্বতী দেবী (বিদ্যা, জ্ঞান, কলা) প্রমুখ সকল দেবতাই যেমন ব্রাহ্মণ-চণ্ডাল-গরু-কুকুর সবার কল্যাণ করেন, তেমনি তাদের সেবা/পূজা করা সবার শুধু অধিকার নয়, কর্তব্যও। সুতরাং পূজা শুধুমাত্র ব্রাহ্মণের অধিকার কখনোই নয়। মা, বাবা, শিক্ষাগুরু, ব্রাহ্মণ – এঁরাও তো পূজনীয়। এঁদের পূজা করবে কে? সবাই।

এবার আসা যাক পুরোহিত প্রসঙ্গে। পৌরহিত্য মূলত একটি গুরুদায়িত্ব, অনেক ক্ষেত্রে এটি একটি পেশাও। মুচি যেমন জুতা সেলাই করে জীবীকা নির্বাহ করেন, তেমনি পুরোহিত পূজা-অর্চনা করে জীবীকা নির্বাহ করেন। এমন কথায় চোখ ছানাবড়া করার আবশ্যকতা নেই। কারণ গীতায় ব্রাহ্মণ-চণ্ডালে সমদর্শী হতে বলা হয়েছে (গীতা ৫/১৮)। ব্যাপারটা ব্যাখ্যা করে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ নিজেই বলেছেন, সকল কর্মই সমান গুরুত্বপূর্ণ ও মর্যাদাময়। প্রতিটি মানুষ নিজ নিজ কর্মের দ্বারাই ভগবানের সেবা করে সিদ্ধিলাভ করেন। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ এই সাম্যের বাণী দিয়েছেন মানবজাতিকে (গীতা ১৮/৪৫-৪৭)। আর এটা নারী-পুরুষ, ব্রাহ্মণ-চণ্ডাল সকলের ক্ষেত্রেই সমানভাবে প্রযোজ্য। 

ব্রাহ্মণবংশীয় ব্যক্তি যেমন যোগ্যতানুযায়ী শূদ্রের পেশা (চাকরি) গ্রহণ করতে পারেন, তেমনি শূদ্রও তার যোগ্যতানুযায়ী ব্রাহ্মণবংশীয়দের পেশা (পৌরহিত্য) গ্রহণ করতে পারেন। হিন্দুশাস্ত্র এর বিরোধিতা করে না, বরং এটাই নিয়ম।

লেখক: সাংবাদিক ও যোগপ্রশিক্ষক