আব্দুল গাফফার চৌধুরী ||
বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, সাম্প্রদায়িকতা হচ্ছে দুমুখো সাপের মতো। সে শত্রুকে খায়, মিত্রকেও মারে। এ কথাটা যে কত সত্য, তা এখন উপমহাদেশের অবস্হা দেখে বোঝা যায়। ভারতে চলছে মুসলিম নিধন, বাংলাদেশে চলছে হিন্দু নির্যাতন। এর মাঝখানে আরো একটি উপসর্গ দেখা দিয়েছে।
বিদেশে, বিশেষ করে বিলাতে এবং আমেরিকায় যেসব হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান আছে, তাদের মধ্যে সাম্প্রদায়িকতা প্রচারের জন্য চলছে এক অভিনব কৌশল। আমি কয়েক বছর আগে নিউ ইয়র্কে গিয়েছিলাম। সেখানে হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের এক নেতা ছিলেন সীতাংশু বাবু। তার অনুরোধে তাদের সভায়ও আমি গিয়েছিলাম। এখন শুনছি তারা বর্তমানে ভারতের বিজেপির হয়ে কাজ করছেন।
এদিকে বাংলাদেশে সম্প্রতি বানারীপাড়া উপজেলায় হিন্দু নির্যাতনের এক নতুন খবর পাওয়া গেছে। সেখানে আওয়ামী লীগের এমপি শাহ আলম ও তার সহযোগীরা হিন্দু সম্পত্তি দখলের জন্য হুমকি-ধমকি দিচ্ছেন। হিন্দু সম্প্রদায়ের ভুক্তভোগীরা সম্প্রতি এ ব্যাপারে বরিশাল শহরে এসে সংবাদ সম্মেলন করেছেন। তাদের অভিযোগপত্র আমার হাতেও এসে পৌঁছেছে। দুঃখিত হয়ে ভাবছি, ‘রক্ষক যদি ভক্ষক হয়, রক্ষা করিবে কে?’
নিউ ইয়র্কে যেসব সংখ্যালঘু নেতা ভারতের বিজেপির হয়ে কাজ করছেন, তারা অধিকাংশই বাংলাদেশের নাগরিক। দীর্ঘদিন ধরে নানা অভাব-অভিযোগের কথা সরকারকে জানিয়ে কোনো ফল না পাওয়ায় তারা এখন ভারতে আশ্রয় গ্রহণ করেছেন এবং বিজেপি তাদের ব্যবহার করা শুরু করেনেছ। এর একমাত্র প্রতিকার বাংলাদেশে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে সম্পূর্ণ নাগরিক অধিকার প্রদান এবং তাদের নিরাপত্তা বিধান। তা না হলে বিদেশে সংখ্যালঘুরা বিজেপির টোপে পড়বে এবং বাংলাদেশের অবস্হা নিয়ে তার প্রতিকারের জন্য বাঁকা পথ ধরবে।
বাংলাদেশে আওয়ামী লীগের কতিপয় মন্ত্রী ও এমপি এবং উপজেলা চেয়ারম্যান যেভাবে সংখ্যালঘুদের প্রতি আচরণ করছেন এবং এখনো তাদের জায়গাজমি দখল করছেন, তার বিরুদ্ধে শক্ত ব্যবস্হা গ্রহণের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে অনুরোধ জানাই। আওয়ামী লীগ বর্তমানে ক্রমশই আওয়ামী মুসলিম লীগে পরিণত হয়েছে। একটি সাম্প্রদায়িক দল দ্বারা দেশে অসাম্প্রদায়িক প্রশাসন প্রতিষ্ঠা করা যায় না।
বহু বছর আগে স্বাধীনতার প্রারম্ভে প্রয়াত যুবলীগ নেতা শেখ মনি একটি সতর্কবাণী উচ্চারণ করেছিলেন। তিনি তার দৈনিক বাংলার বাণী কাগজে লিখেছিলেন, আইয়ুব- মোনায়েমের আমলাদের দ্বারা শেখ মুজিবের সরকার চলতে পারে না। এই অমূল্য কথার তাত্পর্য আমরা কেউ তখন বুঝতে পারিনি। বাংলাদেশের শাসনব্যবস্হা চার-পাঁচ হাত ঘুরেছে, কিন্তু আমলাদের পরিবর্তন হয়নি। এই আমলাদের দ্বারা চালিত হয়ে শেখ হাসিনার সরকার যত কিছু দেশের উন্নয়ন করেছেন, তার সুফল জনগণ সঠিকভাবে পাচ্ছে না।
প্রতিটি জেলা উপজেলায় যারা জনপ্রতিনিধি নির্বাচিত হয়েছেন, তাদের অধিকাংশই নব্য ধনী এবং ব্যবসায়ী। তারা নিজেদের ধনসম্পদ বৃদ্ধি করে চলেছেন এবং তাদের একটা সহজ টার্গেট হিন্দুদের ধন-সম্পত্তি। হিন্দুদের পূজা-পার্বণে এখনো পুলিশকে প্রহরা দিতে হয়, এটা লজ্জার কথা। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সব মেয়ে স্বচ্ছন্দে সর্বত্র ঘোরাফেরা করতে পারছে না, এটা আরো লজ্জার কথা। সংখ্যালঘুদের এখন অনেক উচ্চ সরকারি পদে চাকরি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু সংখ্যালঘুদের ক্ষমতায়ন বাড়েনি।
আবার বঙ্গবন্ধুর কথায় ফিরে যাই। দেশ তখন মাত্র স্বাধীন হয়েছে। আমরা দ্বিতীয় বার দেশভাগের পরিণতি সম্পর্কে আলোচনা করছিলাম। আমি বললাম, বঙ্গবন্ধু ও জিন্নাহ একবার বলেছিলেন, সুভাষ বসু যদি কংগ্রেসের নেতা হতেন, তাহলে ভারত ভাগের দরকার হতো না। আপনি কি মনে করেন, দেশ ভাগের সময় খাজা নাজিমুদ্দিনের বদলে শহীদ সোহরাওয়ার্দি যদি পূর্ববঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী হতেন, তাহলে অখণ্ড পাকিস্তান রাখা যেত? বঙ্গবন্ধু বললেন, না, রাখা যেত না। কারণ শহীদ সোহরাওয়ার্দিকে মুখ্যমন্ত্রী করা হলেও ওরা বাংলাদেশের স্বায়ত্তশাসন দাবি মানত না।
বরং শহীদ সোহরাওয়ার্দিকে মুখ্যমন্ত্রীর পদ থেকে অপসারণ করত। উপমহাদেশ যে আজ তিন ভাগে ভাগ হলো তা রোধ করা যেত, যদি নেহরু ক্রিপস কমিশনের (স্টাফোর্ড ক্রিপসের নেতৃত্বে) প্রস্তাব গ্রহণ করতেন। তার প্রস্তাবে ভারতকে জাতীয়তার ভিত্তিতে এ, বি, সি—এই তিন জোনে ভাগ করে একটি ফেডারেল রাষ্ট্র গঠন করার কথা ছিল। জিন্নাহ এই প্রস্তাব গ্রহণ করেছিলেন, কিন্তু নেহরু তা গ্রহণ করেননি। নেহরু যদি গ্রহণ করতেন, তাহলেই ভারত ফেডারেশনে হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্িরষ্টান সবাই সমান নাগরিক অধিকার নিয়ে বাঁচতে পারত। পাকিস্তান তো ধর্মরাষ্ট্র হয়েছেই। নেহরু উপমহাদেশকে ধর্মের ভিত্তিতে ভাগ করা মেনে নিয়ে ভারতকেও একটি হিন্দু ধর্মরাষ্ট্র হওয়ার পথে ঠেলে দিয়েছেন। আমি হয়তো বেঁচে থাকব না, তোমরা সেই পরিণতি দেখবে।
এটা যেন কোনো প্রফেটের কথা। বর্ণে বর্ণে আজ মিলে গেছে। ভারতে মুসলিম দলন হলে বাংলাদেশে হিন্দু দলন হবে, এটা যেন একটা স্বাভাবিক প্রথা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আমরা এই প্রথা ভাঙতে চাই। হিন্দু-মুসলমানের ভেতরে জাতিভেদ ভাঙতে চাই। সবার বাঙালি পরিচয়টাকে ঊর্ধ্বে তুলে ধরতে চাই। বঙ্গবন্ধুর এই আশা সফল হয়নি। তাকে হত্যা করে বাংলাদেশকে আবার পূর্ব পাকিস্তান করা হয়েছে। পূর্ব পাকিস্তানে হিন্দুদের যেটুকু নিরাপত্তা ছিল, আজ তা-ও নেই। ওদিকে বিদেশে বসে সীতাংশুদের মতো সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের একটি দল বাংলাদেশকে ভারতের কাছে মাথা নত করা একটি দেশ করার অপচেষ্টা চালাচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গের গত সাধারণ নির্বাচনের সময় বিদেশের এই একশ্রেণির সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের লোক বিজেপি যাতে পশ্চিমবঙ্গে জেতে, সেজন্য বেজায় প্রচার চালিয়েছিল।
সূত্র : ইত্তেফাক