ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামের অন্যতম নায়ক শহীদ ভগৎ সিংকে ‘জঙ্গি”বানিয়ে দিলো জম্মু বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক তাজউদ্দীন। এক ঘৃণ্য মানসিকতা থেকেই এমন মন্তব্য। উনি ক্লাস নিতে নিতে শহীদ ভগৎ সিংকে জঙ্গি বলে আখ্যা দেন। ক্লাসের পড়ুয়ারা ক্লাস শেষ হওয়ার পরেই উপাচার্যের কাছে নালিশ জানান। আর তাঁদের অভিযোগ যে মিথ্যে নয়, সেজন্য তাঁরা একটি ভিডিও দেখায় উপাচার্যকে। এই ঘটনার সম্পূর্ন তদন্ত পর্যন্ত অভিযুক্তকে অধ্যাপককে ক্লাস নেওয়া থেকে বিরত রেখেছেন উপাচার্য।

ভগৎ সিং সম্পর্কে আমরা যতটুকু জানি বা আমাদের ইতিহাস বই গুলোতে যা জানানো হয়েছে তা সম্পূর্ন নয়। ১৯০৭ সালে পশ্চিম পাঞ্জাবের লায়ালপুরে (বর্তমান পাকিস্তানে) তার জন্ম। তারপর ব্রাহ্ম সমাজের দয়ানন্দ বৈদিক স্কুলে প্রাথমিক স্তরের পড়াশুনো শেষ করেন। তারপর ১৯২৩ এ লাহোরের ন্যাশনাল কলেজে ভর্তি। এরই মধ্যে নিরস্ত্র মানুষের উপরে ঘটা ১৯১৯ এর নৃসংস জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যা কান্ডের রেশ তাঁর কিশোর মনে ছাপ ফেলে যা তাকে পরবর্তিতে গান্ধীর অহিংস আন্দোলনের পথে না হেঁটে চন্দ্রশেখর আজাদ, রামপ্রসাদ বিসমিলের হিন্দুস্থান রিপাবলিকান অ্যাসোসিয়েসনে যোগ দিতে সহজ করেছিল।
এরপর ১৯২৮ এ লাহোরে সাইমন কমিশনের বিরোধীতা করে লালা লাজপৎ রাইর নেতৃত্বের মিছিলে জেমস স্কটের নির্দেশে পুলিশের লাঠিচার্জে গুরুতর আহত হয়ে কয়েকদিনের মধ্যে লালা লাজপৎ এর মৃত্যু ভগৎ সিংকে গভীর ভাবে নাড়া দিয়েছিল। রাজগুরু ও অন্যান্যদের সাথে নিয়ে বদলা নিতে গিয়ে ভুল বশত স্যান্ডার্স কে হত্যা করা হয়। সেখান থেকে পালিয়ে কিছুদিন আত্মগোপন করে থাকার পর ১৯২৯ এর ৮ই এপ্রিল বটুকেশ্বর দত্তের সঙ্গে দিল্লীর বিধানপরিষদে বোমা নিক্ষেপ ও না পালিয়ে গ্রেপ্তার হওয়া। তারপর শুর হোলো বিচারের নামে প্রহসন।

কিন্তু যে ঘটনার জন্যে ভগৎ সিং কে ইতিহাস সবথেকে বেশি মনে রেখেছে ‚অর্থাৎ স্যান্ডার্স হত্যা সেই ঘটনার সাথে ভগৎ সিং সহ বাকিদের সম্পৃক্ততা আজপর্যন্ত প্রমানই করা যায়নি। পাকিস্তানে ভগৎ সিং এর স্মৃতি রক্ষার কাজে নিয়োজিত আছে ” ভগৎ সিং মেমোরিয়াল ফাউন্ডেশন।” খুব সম্ভবত এদেরই চাপে ভগৎ সিং এর স্মৃতি বিজড়িত একটি স্থান যা জিন্নার বোনের নামে ছিলো‚ সেটা ভগৎ সিং এর নামে করা হয়। যাইহোক এই ফাউন্ডেশনের চেয়ারপার্সন ইমতিয়াজ রশিদ কুরেশি ভগৎ সিংয়ের ফাঁসির ব্যাপারে বিস্তারিত তথ্য চেয়ে আবেদন করেছিলেন লাহোর হাই কোর্টে। আদালত সেই মোতাবেক পুলিশকে নির্দেশ দেয়। পুলিশের দেওয়া তথ্য থেকেই জানা গিয়েছে এক বিষ্ময়কর তথ্য! ১৯২৮ সালের ১৭ ডিসেম্বর অজ্ঞাতপরিচয় যুবকদের গুলিতে খুন হন পুলিশের এসএসপি জন স্যান্ডার্স। প্রথামাফিক ওইদিনই বিকেলে লাহোরের আনারকলি থানায় এফআইআর দায়ের করা হয়। কিন্তু মজাদার বিষয় হল সেই এফআইআরে ভগৎ সিংয়ের নামই ছিল না। ছিল না রাজগুরু এবং সুখদেবের নামও।
অজ্ঞাতপরিচয় বন্দুকধারী’ শব্দগুলি ব্যবহার করা হয়েছিল। অথচ এই এফআইআরের ভিত্তিতে মামলা শুরু হয় ভগত সিং দের বিরুদ্ধে এবং এই “অপরাধেই ” তাদের ফাঁসিতে ঝোলানো হয়।


আরও ইন্টারেস্টিং যেটা তা হল সেই সময় মোট ৪৫০ জন সাক্ষী ছিল। কিন্তু এদের একজনেরও বয়ান নেওয়া হয়নি। শুধুমাত্র যে পুলিশ অফিসাররা বলেছিলেন, ভগৎ সিং দোষী শুধু তাঁদের কথার ওপর গুরুত্ব দিয়েছিলো বিচারক।এমনকি এই পুলিশ অফিসারদের জিজ্ঞাসাবাদ পর্যন্ত করতে দেওয়া হয়নি ভগৎ সিংয়ের আইনজীবীকে।
মানে সোজাসাপটা ভাষায় বলতে গেলে আইনসভায় বোমা ছোড়ার জন্যে ধরা পড়ার পর ভগৎ সিং কে আর বাইরে ছাড়ার রিস্ক নিতে চায়নি ব্রিটিশ সরকার। তাই যেন তেন প্রকারেণ তাকে ফাঁসিতে ঝোলাতেই খুব সম্ভবত স্যান্ডার্স হত্যায় তার নাম তুলে দেওয়া হয়েছিলো।
ইমতিয়াজ কুরেশি জানান, তাঁর পরবর্তী পদক্ষেপ হবে এই ইস্যুতে আসল ঘটনা সবার সামনে আনা। পরবর্তীতে আরো কি কি রহস্য উন্মোচিত হয় লাহোর ষড়যন্ত্র মামলার ব্যাপারে তার এখন প্রতিক্ষা।

আরও বিষ্ময়কর এই যে জীবনে বহু সহিংস আন্দোলনকারীকে ব্রিটিশদের হাত থেকে বাঁচানোর চেষ্টা করে কিছুক্ষেত্রে সফলও হয়েছিলে ভগৎ সিংকে বাঁচানোর জন্যে ন্যূনতম পদক্ষেপ নিতেও অরাজি ছিলেন! যদিও অনেক কংগ্রেসী নেতাই তাকে এই ব্যাপারে আবেদন জানিয়েছিলেন।
কিন্তু গান্ধীজি ভগৎ সিং ইস্যুতে একদমই স্পিকটি নট ছিলেন!
কারন মহাত্মা গান্ধী বুঝেছিলেন তিনি ভগত সিং এর মৃত্যুদণ্ডের পরিবর্তে লঘুদণ্ডের দাবী করলে সেটি দেশের বৃহত্তর স্বার্থের পরিপন্থী হবে। করাচিতে কংগ্রেসের প্রতিনিধিদলের বৈঠকের পূর্বেই যত দ্রুত সম্ভব ভগত সিং এর ফাঁসি কার্যকর করার বিষয়ে গান্ধী তার নিজের লেখায় উল্লেখ করেছেন। গান্ধীর লেখা থেকে নীচে অংশবিশেষ তুলে ধরা হল।

এ প্রসঙ্গে গান্ধী নিজে “তরুণ ভারতে” লিখেছেন, “আমি হয়তো বিষয়টি নিষ্পত্তি করার একটি প্রক্রিয়া হিসেবে দণ্ড লঘু করার প্রস্তাব উত্থাপন করতে পারতাম। কিন্তু এটি করা সম্ভব হত না। এ ব্যাপারে কার্যসভা আমার সাথে একমত পোষণ করেছে যে সাময়িক শান্তিচুক্তির নজির হিসেবে দণ্ড লঘু করার প্রস্তাব পেশ করা সঠিক হবে না। তাই আমি বিষয়টি কেবল উল্লেখই করতে পারতাম।”

সুতরাং, এতে দেখা যায় যে, মহাত্মা গান্ধী যদি চাইতেন তাহলে দণ্ড লঘু করার বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে উত্থাপন করতে পারতেন। ভাইসরয় এর কাছে গান্ধী প্রার্থনা জানিয়ে বলেছিলেন, “ছেলেগুলোকে যদি ফাঁসি দিতেই হয়, তবে তা করাচির কংগ্রেস অধিবেশনের পরে না দিয়ে পূর্বেই যেন দেওয়া হয়”- সুতরাং তার পক্ষ থেকে ভগত সিং ও তাঁর সহযোগী
রাজগুরু ও সুখদেব মৃত্যুদণ্ড লাঘবের চেষ্টা করার বিষয়টি প্রত্যাশা করা যায় না। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায় যে, লাহোরের সর্ব ভারতীয় ভগত সিং, রাজগুরু ও সুখদেব স্মৃতিরক্ষা কমিটির পক্ষ থেকে গান্ধীর কাছে এই তিন জাতীয় বীরের স্মৃতি রক্ষার্থে একটি স্মৃতিস্তম্ভ স্থাপনের বিষয়ে গান্ধীর সহযোগিতা কামনা করলে তিনি কমিটির সাধারণ সম্পাদককে এ বিষয়ে সহযোগিতা প্রদানের ব্যাপারে অস্বীকৃতি জানান।

প্রসঙ্গক্রমে বল যায় সেই সময় সশস্ত্র আন্দোলনকে সন্ত্রাসবাদী আন্দোলনই বলা হতো‚অর্থাৎ অথরিটিকে সন্ত্রস্ত করে দাবি আদায় করে নেওয়া। এটা এতটা নেগেটিভ চোখেও দেখা হোতোনা। প্রথমে সোভিয়েত আর পরে আরবের ফান্ডে টাকায় পুষ্ট ইসলামী জঙ্গীরা যেদিন থেকে আদর্শবাদী এবং ন্যায়নিষ্ট সন্ত্রাস এর রাস্তা ছেড়ে বিধর্মী সাধারণ মানুষদের হত্যা করতে শুরু করলো সেদিন থেকেই সন্ত্রাসবাদের সাথে জেহাদ সুচারুভাবে জুড়ে গিয়ে আজকের এই ঘৃণ্য নেগেটিভ চেহারা নিল।

ভগৎ সিং একজন নাস্তিক হওয়া সত্তেও একজন প্রবল জাতীয়তাবাদী ছিলেন, নিজের জীবন উৎসর্গ করে ভারতের যুব সমাজকে ভারতের স্বাধীনতার জন্য লড়াই করতে উদবুদ্ধ করে গেছেন।

তাঁদের আত্মবলিদান দিবসে ভগত সিং ,রাজগুরু ও সুখদেব দের বিনম্র শ্রদ্ধার সঙ্গে শতকোটি নমন জানাই।