করোনাভাইরাসের কারণে সৃষ্ট পরিস্থিতিতে ফুলবাড়িয়ায় তিনশ' কোচ-বর্মণ পরিবার কর্মহীন হয়ে চরম অভাবে দিন কাটাচ্ছে।

জন্মের পর থেকেই মায়ের বুকের দুধ পাচ্ছে না ছয় মাসের অঙ্কিতা। বাধ্য হয়ে কৌটার দুধ খাওয়াতে হচ্ছে। বাবা পাইলট চন্দ্র বর্মণ এখন দুধ কোথায় পাবেন- কাজ নেই, টাকাও নেই। সামান্য চালের সুজি খাইয়ে কোনোমতে বাঁচিয়ে রেখেছেন শিশুটিকে। টাকার জন্য বাবা হন্যে হয়ে ঘুরছেন, আর চোখের পানি ফেলছেন মা রত্না চন্দ্র বর্মণ।

এই পরিবারের মতো ময়মনসিংহের ফুলবাড়িয়ার ৩০০ কোচ-বর্মণ পরিবারে ১২০০ মানুষের একই অবস্থা। চরম খাদ্য সংকটে ভুগছে ক্ষুদ্র জাতিসত্তার এই মানুষগুলো। সরকারি সাহায্য তো দূরের কথা, কোনো ব্যক্তি বা সংগঠন কেউ তাদের সহায়তায় এখন পর্যন্ত এগিয়ে আসেনি।

ফুলবাড়িয়া উপজেলার রাঙামাটি ইউনিয়নের বাবুলের বাজার, কালাদহ ইউনিয়নের বিদ্যানন্দ গ্রাম, এনায়েতপুর ইউনিয়নের দুলমা গ্রাম, বাক্তা এবং পুটিজানা ইউনিয়নের কোচ-বর্মণপাড়ায় এখন এমন অবস্থা বিরাজ করছে।

শিশুকন্যা অঙ্কিতার মা অশ্রুসিক্ত চোখে বলেন, 'জীবনে কোনোদিন এমন দিন দেহি নাই দাদা। বিলের মাছ বাজারে বেচতে না পাইরা চালে হুকনা দিছি। ঘরে চাইল নাই, মেয়ারে এক মাস হইলো হুদা সুজি খাওয়াই পালতাছি। নিজেরা এক-আধবেলা না খায়া থাকতে পারি, কিন্তু বাচ্চাটার এই কষ্ট কত সহ্য করন যায়। মেয়ের বাপ সারাদিন কাম খোঁজে। অহন কিয়ের করুনা নাকি, হেইডার লাইগা কেউ কাজ দেয় না।'

পরিবারের সবচেয়ে বয়োবৃদ্ধ পরিমহন চন্দ্র বর্মণ (৮৫)। স্ত্রী-সন্তান ও নাতি-নাতনি মিলিয়ে সদস্য সংখ্যা ১৫। গত প্রায় এক মাস কুটিরশিল্পের মালপত্র বিক্রি করতে না পারায় সর্বস্বান্ত হয়ে গেছে তার পুরো পরিবার। ক্ষুধার তাড়নায় ঘর ছেড়ে বাইরে এসে পড়েছেন তারা। আশায় বুক বেঁধে আছেন, কেউ তাদের জন্য সাহায্য নিয়ে হাজির হবে হয়তো।

কোচপাড়ার দক্ষিণের বাড়ি মাখন চন্দ্র বর্মণের। তার বড় ছেলে স্বপন বর্মণ জানান, ঘরে তৈরি মালপত্র বাজারে বিক্রি করতে না পেরে বাবার মাথায় সমস্যা দেখা দিয়েছে। মাখন চন্দ্রের পাশে বিমর্ষ হয়ে বসে ছিলেন তার স্ত্রী চিন্তামণি বর্মণ। কেমন আছেন জিজ্ঞেস করতেই বললেন, 'ভালা, আপনে সরকারি লোক? চাইল আনছেন বাপু? আমগো ঘরের চাল নাই। বড় ছেলে ফুলবাড়িয়া সরকারি হাসপাতালে তার বাবারে নিয়া গেছিল, ডাক্তাররা রোগী দেহে না।'

বর্মণপাড়ার বিমলা, সরস্বতী, অনীতা, কল্পনা, সনিকা বর্মণ জানান, তারা নিজেদের পাড়ায় কুটিরশিল্পের কাজ করেন। এ কাজে মহাজনরা তাদের বাঁশ কিনে দেন। এ দিয়ে তারা বাঁশের ধারি, চাটাই, কুলা, ডালি, চালনি ইত্যাদি তৈরি করেন। এখন দেশে করোনাভাইরাসের কারণে এগুলো বেচাকেনা বন্ধ। মহাজনও মাইনে দেন না।

ট্রাইবাল ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশনের উপজেলা শাখার সভাপতি লুইস সুপ্রভাত জেংচাম বলেন, ফুলবাড়িয়ার কোচ-বর্মণ পরিবারগুলো খুব কষ্টে আছে। এই মুহূর্তে তাদের মানবিক সাহায্য অত্যন্ত জরুরি।

হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের উপজেলা শাখার সভাপতি বিপুল হুর বলেন, হতদরিদ্র পরিবারের কেউ তাদের কষ্টের কথা কাউকে বলতে চায় না, আবার তাদের খোঁজ কেউ নেয় না। এই দুর্যোগ মুহূর্তে সরকারি সহায়তার পাশাপাশি তাদের জন্য সমাজের বিত্তবানদের এগিয়ে আসা উচিত।

রাঙামাটির ইউপি চেয়ারম্যান সালিনা চৌধুরী সুষমা বলেন, আমি নিজে গিয়ে এসব পরিবারে যাদের অবস্থা একেবারেই খারাপ, তাদের তালিকা তৈরি করে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাতে (ইউএনও) দেব।

ইউএনও আশরাফুল ছিদ্দিক বলেন, বর্মণ-কোচ পরিবারের সরকারি সহায়তার জন্য স্ব স্ব ইউনিয়ন চেয়ারম্যানদের কাছ থেকে আলাদা তালিকা চাইব এবং ব্যবস্থা নেব।