রামায়ণ, মহাভারতেরও বহুকাল আগে থেকে ভারতবর্ষে সংস্কৃত ভাষার প্রচলন রয়েছে। বর্তমানে ভারতবর্ষে যত ভাষার প্রচলন রয়েছে তার প্রায় প্রত্যেকটিই সংস্কৃত ভাষা থেকেই জন্ম নিয়েছে। এই কারণেই সংস্কৃত ভাষাকে সকল ভাষার জননী বলা হয়। একে পবিত্র বিবেচনা করা হয় এবং দেবভাষা বলা হয়।

কিন্তু বর্তমানে সংস্কৃত ভাষার চর্চা নেই বললেই চলে। ফলে সংস্কৃত ভাষায় কথা বলে এমন মানুষের দেখা পাওয়া দুর্লভ। তবে দুর্লভ হলেও একেবারে বিলুপ্ত হয়ে যায়নি মানুষের মুখ থেকে। এখনও কয়েক হাজার ভারতীয় আছেন যাদের নিত্যনৈমিত্তিক জীবনের ব্যবহার্য ভাষা সংস্কৃত।

ভারতে এখন পর্যন্ত ৭টি গ্রাম রয়েছে যে গ্রামগুলোতে শিক্ষিত-স্বল্পশিক্ষিত সকলেই সংস্কৃত ভাষায় কথা বলেন। একে ওপরের সাথে সামান্য কথাবার্তার জন্যেও সংস্কৃত ভাষার ব্যবহার করেন। হাট-বাজারে কেনাকাটা, চায়ের দোকান থেকে শোয়ার ঘর পর্যন্ত সর্বত্রই মানুষের মুখে উচ্চারিত হয় সংস্কৃত ভাষা।

সংস্কৃত ভাষাভাষী ৭টি গ্রামের মধ্যে সবচেয়ে আলোচিত হলো কর্ণাটক রাজ্যের শিমোগা জেলার মাত্তুর গ্রাম। তুঙ্গা নদীর তীরে অবস্থিত এই গ্রামের বাচ্চা থেকে বুড়ো সকলেই সংস্কৃত ভাষায় মনের ভাব প্রকাশ করেন। গ্রামটি কোনো ছোট গ্রাম নয়। মাত্তুর গ্রামে ৫ হাজার মানুষ বাস করেন। গ্রামটির বিকাশ ভারতের অন্যান্য গ্রামের মতোই হয়েছে। এই গ্রামের শিশুরা ১০ বছর বয়স থেকে বেদ পাঠ শুরু করে।

গ্রামে ‘কথম অস্তি’ (কখন এসেছেন), ‘অহম গচ্ছামি’ (আমি যাচ্ছি) ইত্যাদি সংস্কৃত কথা সব সময় শোনা যায়। আজকের আধুনিক সময়ে ভারতের ঐতিহ্যকে ধরে রাখার জন্য মাত্তুর গ্রাম এক দুর্দান্ত উদাহরণ। এমন নয় যে, গ্রামটি দেশ ও বিশ্বের পরিবেশের সাথে তাল মিলিয়ে চলে না। এই গ্রামের ঘরে ঘরে মেধাবী ও প্রতিভাবান ব্যক্তিত্ব ও পেশাদার লোকজনের খোঁজ মেলে।

১৯৮১ সালে সংস্কৃত ভারতী নামের এক সংস্থা মাত্তুর গ্রামে  ‘১০ দিনে সংস্কৃত ভাষা শিক্ষা’ কর্মসূচি পরিচালনা করেছিল। গ্রামের মানুষজন তখন সংস্কৃত ভাষার প্রতি দারুণ আগ্রহ দেখায়। তারা একে একে প্রায় সকলেই সংস্কৃত ভাষায় কথা বলা শিখে নেন। এরপর দ্বিতীয় প্রজন্ম সংস্কৃত ভাষা শিখেছে মাতৃভাষা হিসেবে।

মাত্তুরের পর উল্লেখযোগ্য দ্বিতীয় গ্রামটি হলো ঝিরি। মধ্যপ্রদেশের রাজগড় জেলার সরংপুর উপজেলায় ঝিরি গ্রামটি অবস্থিত। স্থানীয় আঞ্চলিক ভাষা মাউলি এখন প্রায় হারিয়েই গেছে এই গ্রাম থেকে। গত ১৬ বছরের মধ্যে সেই স্থানটি দখল করে সবার মুখে মুখে এখন শোভা পাচ্ছে সংস্কৃত ভাষা।

বিমলা তিওয়ারি নামের এক ব্যক্তি এই গ্রামে প্রথম উদ্যোগ নিয়েছিলেন। ২০০২ সালের কথা এটা। মাত্র এক বছরের জন্য তিনি গ্রামটিতে এসেছিলেন। মাত্র এক বছরেই তিনি গ্রামের মানুষের মধ্যে এই দেবভাষা শেখার প্রতি ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনা সৃষ্টি করেন। তার উদ্যোগে সংস্কৃত ভারতী এখানে সংস্কৃত সম্ভাষণ ক্যাম্প আয়োজন করে। এখন আবাল-বৃদ্ধ-বণিতা সকলেই কথা বলেন সংস্কৃত ভাষায়।

এছাড়াও সংস্কৃত ভাষায় কথা বলে এমন আরও ৫টি গ্রাম হলো মধ্যপ্রদেশের নরসিংহপুর জেলার করেলি উপজেলার বঘুবর গ্রাম, উড়িষ্যার গজপতি জেলার সসনা গ্রাম, রাজস্থানের বনস্বরা জেলার ঘাটলি উপজেলার গনোরা গ্রাম, মধ্যপ্রদেশের বুরহানপুর জেলার মোহাদ গ্রাম, এবং কর্ণাটকে মাত্তুরের পাশাপাশি আরেকটি গ্রাম হোসাহল্লি।

উল্লেখ্য, সংস্কৃত ভারতী নামের একটি সংস্থা সমগ্র ভারতব্যাপী সংস্কৃত ভাষা শিক্ষার প্রচার-প্রসারের জন্য দীর্ঘকাল ধরে কাজ করে যাচ্ছে। বিশেষত তাদের সংস্কৃতে কথা বলার সহজ কর্মসূচি ‘সংস্কৃত সম্ভাষণ’ দারুণ জনপ্রিয়। সংস্থাটির প্রয়াসে ভারতজুড়ে এখন পর্যন্ত অন্তত ৩০ হাজার মানুষ প্রাত্যহিক জীবনে সংস্কৃত ভাষায় কথা বলেন।

আরও পড়ুন: মাইনাস ৪৫ ডিগ্রি তাপমাত্রায় ধ্যানস্থ যোগী, দুর্লভ ভিডিও ফাঁস করলেন ভারতীয় সেনা