নেত্রকোণাঃ এনামূল হক পলাশ বাংলা ভাষার সহজিয়া ধারার একজন প্রতিশ্রুতিশীল কবি। একাধারে তিনি একজন লেখক, কবি, প্রাবন্ধিক, গল্পকার ও শিশু সাহিত্যিক। তিনি 'অন্তরাশ্রম' নামে একটি পত্রিকা সম্পাদনা করেন এবং একই নামে একটি সাংস্কৃতিক সংগঠন পরিচালনা করেন।
প্রাবন্ধিক ও লেখক অধ্যাপক বিধান মিত্র বলেন, “এনামূল হক পলাশ, আপাদমস্তক কবি-মাটির কবি, মানুষের কবি; জীবনের কবি, মরমের কবি। এনামূল হক পলাশ বঙ্কিম-কথিত উৎকর্ষ আদর্শ সামগ্রীর কাব্যিক-শরীর দানকারী সৃষ্টিশীল কবি। আমাদের বোধ ও বিদ্যায় জনসনতত্ত্বকে স্থাপন করে আমরা যদি এনামূল হক পলাশরচিত কবিতাগুলো পড়ি, তাহলে দেখবো-তিনি যা লিখেছেন, সবই পলাশ-রাঙানো কবিতা, রূপ-রস-বর্ণ-গন্ধময় কবিতা, ‘কবিতা নয়’ (বা কবিতা হয়ে ওঠেনি) এমন একটা লেখাকেও তিনি ‘কবিতা’ হিসেবে চালিয়ে নেবার দুশ্চেষ্টা করেননি। বর্তমান আধুনিক কবিতার হরেক রকম ‘তত্ত্ব’ ও ‘বাদ’ দ্বারা প্রভাবিত হয়ে তিনি তাঁর ভাবনাপূঞ্জকে পাঠক-বোধাতীত জগতে নিয়ে যাননি, কবিতার ভাব-লয়-দেহকে তিনি বরাবরই মাটি ও মানুষ সংলগ্ন রেখেছেন, ভাবের জগতকে চোরাবালির ফাঁকে নিয়ে যাননি, সাধারণ পাঠকের মেধা ও বোধকে ‘পরীক্ষার’ আসনে বসাননি।”
কবি কানিজ মাহমুদ বলেন, “একটি নতুন দিনের স্বপ্ন দেখি আমরা সবাই। দেখতে দেখতে স্বপ্নটাই পুরানো হলো,তবু স্বপ্ন স্বপ্নই রয়ে গেলো, বাস্তবায়নের কিছুই হলো না। স্বাপ্নিকরা ও ক্লান্ত এখন কেউ বা নিরাশ হয়ে ফিরে গেছেন। কেউ বা সিঁড়ি ডিঙিয়ে স্বপ্ন ছোঁয়ার আহবানে প্রজন্মের পর প্রজন্ম প্রলুব্ধ করছেন।যাদের স্বপ্ন দেখা বা দেখানো শেষ হয় না তারাই কবি,আজন্ম স্বপ্নদ্রষ্টা। পরিবার, সমাজ ,রাষ্ট্রের নানা অসংগতির বিরুদ্ধে দাড়িয়ে থাকেন আপোষহীন। এমন'ই এক আপাদমস্তক কবি এনামূল হক পলাশ।”
কবি এনামূল হক পলাশ ১৯৭৭ সালের ২৬ জুন নেত্রকোনা জেলার বারহাট্টা উপজেলার বাদে চিরাম গ্রামে মাতুলালয়ে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পৈত্রিক নিবাস একই উপজেলার বামনগাঁও গ্রামে। পিতা মরহুম এমদাদুল হক, মাতা- নুরুন্নাহার হক।
শিশুকাল নিজ গ্রামে কাটালেও পিতার ব্যবসাজনিত কারনে তাঁর শৈশব কেটেছে বারহাট্টায়। গোপালপুর বাজারে। বারহাট্টা সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে প্রথম শ্রেনীতে ভর্তি হয়ে একই স্কুল থেকে ১৯৮৮ সালে ট্যালেন্টপুল বৃত্তি পেয়ে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্ত করেন। বারহাট্টা সি.কে.পি. পাইলট উচ্চ বিদ্যালয় হতে তিনি অষ্টম শ্রেনীতে সাধারণ বৃত্তি পান এবং পরের বছর ড. ইন্নাছ আলী বৃত্তি প্রাপ্ত হয়ে ১৯৯৪ সালে বিজ্ঞান শাখায় প্রথম বিভাগে এসএসসি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন।
১৯৯৪ সালে উপজাতীয় কালচারাল একাডেমী থেকে প্রকাশিত 'মাটির সুবাস' নামক একটি পত্রিকায় তাঁর একটি কবিতা প্রকাশিত হয় যা ছিল ছাপার অক্ষরে তাঁর প্রথম কবিতা। প্রকাশিত কবিতার জন্য তিনি মানি অর্ডার যোগে চল্লিশ টাকা সম্মানী প্রাপ্ত হয়েছিলেন। উক্ত চল্লিশ টাকার খরচ বাদে সাতত্রিশ টাকা পঁচিশ পয়সা হাতে পেয়েছিলেন তিনি। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ব বিদ্যালয় ইন্টারমিডিয়েট কলেজ থেকে তিনি ১৯৯৬ সালে প্রথম বিভাগে এইচ এস সি পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ১৯৯৭ সালে সরকারী তিতুমীর কলেজে উদ্ভিদ বিজ্ঞানে অনার্স ভর্তি হন। ১৯৯৮ সালে বন্যা জনিত কারনে পিতার ব্যবসা ক্ষতিগ্রস্থ হওয়ায় পারিবারিক সংকট এড়াতে নেত্রকোণা সরকারী কলেজে চলে আসেন এবং একই কলেজ থেকে ২০০২ সালে দ্বিতীয় শ্রেনীতে স্মাতক (সন্মান) উত্তীর্ণ হন। নেত্রকোনা সরকারী কলেজে উদ্ভিদ বিজ্ঞানে মাস্টার্স পড়ার সুযোগ না থাকায় তিনি গুরু দয়াল সরকারী কলেজে হতে ২০০৪ সালে উদ্ভিদ বিদ্যায় দ্বিতীয় শ্রেনীতে মাস্টার্স পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন। ১৯৯৮ সালে একটি প্রগতিশীল বাম সংগঠনের সাথে তাঁর যোগাযোগ স্থাপন হয় এবং তিনি প্রগতিশীল বিপ্লবী রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। এ সময় রাজনৈতিক বিষয়ে ব্যপক অনুশীলন ও পড়াশোনা করেন। এই সময়টা তিনি অনেক পড়াশোনা এবং কবিতা লেখার ভেতর দিয়ে কাটিয়েছেন। ১৯৯৮ সাল থেকে ২০০৩ সাল পর্যন্ত তিনি বিভিন্ন সময় কয়েকটি জাতীয় ও স্থানীয় দৈনিক পত্রিকার সাথে যুক্ত থেকে সাংবাদিকতা করেছেন। ২০০৩ সালে তিনি রাজনীতি ছেড়ে সরকারী চাকুরিতে যোগদান করেন।
২০০৯ সালে কবির প্রথম বই “অস্তিত্বের জন্য যুদ্ধ চাই” প্রকাশিত হয়। এছাড়া এখন পর্যন্ত জীবন এক মায়াবী ভ্রমণ, অন্ধ সময়ের ডানা, অন্তরাশ্রম, মেঘের সন্ন্যাস, পাপের শহরে, জল ও হিজল, তামাশা বাতাসে পৃথিবী, অখন্ড জীবনের পাঠ, লাবণ্য দাশ এন্ড কোং সহ মোট দশটি কাব্যগ্রন্থ ও বইয়ের পাতায় ফুলঝুরি, কলমিলতার ফুল, মগড়া নদীর বাঁকে নামে তিনটি শিশুতোষ কবিতার বই এবং ভূমি ব্যবস্থাপনার সরল পাঠ নামে একটি গবেষণাগ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। এর মধ্যে তিনি প্রাচীন আরবি সাহিত্যের কিছু কবিতা অনুবাদ করেছেন। তার দুটি অনুবাদ গ্রন্থ হচ্ছে, ধর্ম বিশ্বাস আখ্যানের মতো সুন্দর এবং মু - আল্লাক্বা।
২০১৬ সালে কবি নির্মলেন্দু গুণ প্রতিষ্ঠিত নেত্রকোণার মালনী এলাকায় বিশ্ব কবিতার আবাসস্থল বা হোম অব ওয়ার্লড পয়েট্রি খ্যাত “কবিতাকুঞ্জ” প্রতিষ্ঠার সূচনালগ্ন থেকে অবকাঠামো গঠনের কাজে যুক্ত থেকেছেন এবং একই প্রতিষ্ঠানের প্রথম পরিচালক হিসেবে কবি কর্তৃক নিযুক্ত আছেন। ২০১৭ সালে কবি, লেখক ও সংস্কৃতি কর্মীদের ব্যবহারের জন্য তিনি নেত্রকোণা শহরের মালনী এলাকায় গড়ে তুলেছেন “অন্তরাশ্রম” নামে একটি প্রতিষ্ঠান। তিনি এর প্রতিষ্ঠাতা ও আচার্য। ২০১৭ সালে নেত্রকোনার কেন্দুয়া উপজেলার 'চর্চা সাহিত্য আড্ডা' কর্তৃক তাদের শততম আসরে অন্যান্যদের সাথে “চর্চা শুভেচ্ছা সন্মাননা- ২০১৭” প্রাপ্ত হন। ২০১৮ সালে কবির চল্লিশ পূর্তি উপলক্ষে কবির জীবন ও কর্ম নিয়ে “আশ্রম পাখির মায়াপথ” নামে একটি প্রকাশনা গ্রন্থ বের হয়। ২০১৯ সালে তিনি নিজ গ্রামের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সামনে 'কুপি বাতি ' নামে একটি ভাস্কর্য স্থাপন করেন। ভাস্কর্যটি তৈরি করে দিয়েছেন বিখ্যাত ভাস্কর অখিল পাল। ২০২২ সালে তার কিছু কবিতা নিয়ে ইংরেজিতে ভাষান্তরিত বই CROSSING FORTY NIGHTS পশ্চিম বঙ্গ থেকে প্রকাশিত হয়।
কবি এনামূল হক পলাশ সহজের সাধনা করেন। সাধারণ হয়েই থাকতে চান মানুষের কাছে। তিনি মনে করেন নিজের গাছ থেকে নিজের অক্সিজেন সংগ্রহ করবেন। তাঁর ছাদ ঘুরে দেখা গেছে ছোট ছোট চৌবাচ্চায় শাপলা- পদ্ম ফুটে আছে। ছাদে পদ্ম ফুটিয়েছেন বলে কবি নির্মলেন্দু গুণ তাঁর বাসস্থানের নাম দিয়েছেন স্থলপদ্ম। বর্তমানে তিনি বসবাস করেন সেখানে।
তাঁর সাথে কথা হলে তিনি জানান, 'জীবনের বিচিত্রতা আমাকে দিন দিন সহজ হওয়ার সাধনার দিকে নিয়ে গেছে। তাই সহজের সাধনা করি। আমি সাধু নই। সাধু হতেও চাইনা। সহজ হতে চাই। অন্তরাশ্রমের পথ বেয়ে পৃথিবীর পথে পথে ছড়িয়ে দিতে চাই ভালোবাসা ফুল।'
কবি এনামূল হক পলাশ সম্পর্কে নেত্রকোণা সরকারী কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ প্রফেসর শীতাংশু কুমার ভদ্র বলেছেন, “জ্ঞান ও কর্মে ছাত্রের নিকট পরাস্ত হওয়াই শিক্ষকের অহংকার। আমি সেই অর্থে অহংকারী। সাহিত্য ও সাংগঠনিক কর্মকান্ড, সাধারণ মানুষের প্রতি সহানুভূতি, প্রকৃতি প্রেমী, পরিবেশ বান্ধব-কর্মসূচীতে স্বকিয়তা, সত্যকথা অকপটে বলা, বন্ধু বাৎসল্য, পরিবার পরিজনের সংগে সদ্ভাব,সন্তানের প্রতি অকৃত্রিম স্নেহ ও সুশিক্ষার প্রয়াস, প্রকৃতির প্রতি মায়া,বিরল প্রজাতি উদ্ভিদ ও প্রাণী সংরক্ষণে তৎপরতা, নিজ আবাসে জীবের সমাহার ঘটানো এবং সুবিধা বঞ্চিত সরল গণমানুষের জন্য সহযোগিতার হাত তার প্রসারিত। মানুষকে মানুষ হিসেবে মূল্যায়ন করে তার আত্মতৃপ্তি জেনে আমি খুবই খুশী হই এবং গর্ববোধ করি।
কবি সজল অনিরুদ্ধ বলেন, “অন্তরাশ্রমে বেদনায় ক্লিষ্ট কবি সন্ন্যাসব্রত গ্রহণ করেছেন। কিন্তু, না। এই সন্ন্যাসে গিয়ে কবি যেন আরও বেশি সমাজ সচেতন হয়ে উঠেছেন। ভুলে যাননি তার হাড় জিরজিরে কৃষকের কথা। ভুলে যাননি বিপন্ন মানুষের কথা। মানুষের জন্যই, মানবতার জন্যই কবির এই সন্ন্যাস গ্রহণ। আমিত্বকে ছেড়ে মানুষ যখন সর্বজনীন হয়ে উঠে তখন তার শক্তির প্রতাপ আরো বাড়ে। আমাদের মেঘের সন্ন্যসী সেই শক্তি অর্জন করেছেন।”
তাছাড়া কবি পলিয়ার ওয়াহিদ বলেন, “তিনি নিজস্ব জনপদের মুখের ভাষাকে কবিতায় স্থান দিয়েছেন বুক উঁচু করে। গোয়ো আর আঞ্চলিক তকমাকে গায়ে না মাখিয়ে উল্লাসে প্রকাশ করেছেন কবিতার আপন বৈভব। কি অসাধারণ উপমায় আধুনিক সংসারকে ইঙ্গিত করলেন। সত্যি বিস্মিত না হয়ে পারি না। এনামূল হক পলাশ ভাইয়ের কবিতা মূলত পাঠের, তা লিখে বোঝানো সত্যিই বোকামী। প্রতিটি কবিতা তিনি দর্শনরসে চুবায়ে পরিবেশন করেন সাদামাটাভাবে। আর এখানেই তার মুন্সিয়ানা ধরা পড়ে ষোলআনা। এতো সহজ ভাষায় প্রকাশ করেন যে, পাঠের পর রয়না মাছের মতো ফাঁদে হা হয়ে পড়ে থাকা ছাড়া উপায় থাকে না!”
জন্মদিনে অফুরন্ত শুভেচ্ছা ও ভালবাসা কবির প্রতি।
প্রতিবেদক, বাংলাদেশ দর্পণ