‘হিন্দুহৃদয়সম্রাট’ বলে নরেন্দ্র মোদীকে যতই গুণগান করা হোক না কেন, মোদীজি যা করেন, তা সবই ভারতের কল্যাণের জন্য অথবা তার রাজনৈতিক দল বিজেপির রাজনীতির জন্য। বাংলাদেশের হিন্দুদের তাতে উচ্ছ্বসিত হওয়ার কিছু নেই।
আজ পর্যন্ত বাংলাদেশের সংখ্যালঘু হিন্দুদের সুরক্ষার জন্য কী করেছে ভারত? কিছুই করেনি। একাত্তরে বাংলাদেশের স্বাধীনতায় ভারত যা কিছু সহযোগিতা করেছিল, সেটা তার শত্রু রাষ্ট্র পাকিস্তানকে ভেঙে দুর্বল করার জন্যই। বাংলাদেশের হিন্দুদের স্বাধীন বাংলাদেশে পূর্বের চেয়ে অবস্থা খারাপ ছাড়া ভালো হয়নি। এ নিয়ে ভারতের বিন্দুমাত্র আগ্রহ নেই।
বাংলাদেশের হিন্দুরা বাঁচলে বা মরলে, মন্দির-দেববিগ্রহ ধ্বংস হলে, মিথ্যা মামলায় জেলে ভরলে, হিন্দুদের দেশ ছাড়তে বাধ্য করলে বা তাদের ধর্ষণ, লুণ্ঠন যা কিছু হোক না কেন, তাতে ভারতের কিছুই যায় আসে না। বরং ভারত হয়তো এটাই চায়। কারণ, তাতে বাংলাদেশ সরকারকে চাপে রেখে ভারত নিজেদের স্বার্থ হাসিল করতে পারবে।
এই যে রক্তাক্ত শারদ পার করলাম আমরা, হিন্দুদের তথাকথিত অভিভাবক ভারত এ নিয়ে একটা শব্দ উচ্চারণ করেনি। হিন্দুদের সুরক্ষা বা ক্ষতিপূরণ দিতে ভারত চাপ দেয়নি। রামুর সহিংসতা শেষে বাংলাদেশের শীর্ষ নেতারা সেখানে ছুটে গিয়ে বৌদ্ধদের সব মন্দির ও গৃহ পুনরায় উন্নততর করে গড়ে দিয়েছেন। কারণ, সেখানে বৌদ্ধপ্রধান দেশসমূহের চাপ ছিল। কিন্তু হিন্দুপল্লীতে একের পর এক এত বড় বড় সহিংসতা হওয়ার পরও কোনো মন্ত্রী পর্যায়ের কেউ সেখানে দেখতেও যায় না, অনেক সময় এমপিরাও যায় না। এসপি-ডিসিই সামলে নেয় সবকিছু। হিন্দুদের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক গুরুত্ব নেই কারো কাছে।
বাংলাদেশের হিন্দুরা ভারতে আশ্রয় নিলে তাদের নাগরিকত্ব দিতে বিজেপি আইন পাশ করেছে। সুতরাং বিজেপি এদেশের হিন্দুদের নিয়ে চিন্তা করে - এমনটা ভাবার কোনো অবকাশ নেই। বাংলাদেশে হিন্দুদের প্রকৃত কল্যাণ করতে হলে ভারতের উচিত সীমান্তে আরও কড়াকড়ি আরোপ করা। যাতে কোনো হিন্দু দেশত্যাগ করতে না পারে। দেশত্যাগের সুযোগ না থাকলে তখন হিন্দুরা লড়তে শিখবে। কঠিন পরিস্থিতির সাথে সংগ্রাম করে বা অভিযোজন করে টিকে থাকতে শিখবে। অন্যথায় এক পা ভারতে রাখা হিন্দুদের প্রকৃত কল্যাণ সিএএ আইনের দ্বারা হবে না। তবে এই আইনে ভারতের স্বার্থ আছে। কারণ, বাংলাদেশ থেকে কোনো হিন্দু যদি ভারতে যায়, নিশ্চয় তার স্থাবর-অস্থাবর সকল সম্পত্তি বিক্রি করে একগাদা টাকা সঙ্গে নিয়ে ভারতে যাবে। দু’টি হিন্দু পরিবার যদি ৫০ লাখ টাকা করে সঙ্গে নিয়ে ভারতে গিয়ে স্থায়ী হয়, তাতে ভারতের অর্থনীতিতে এক কোটি টাকা যুক্ত হয়। বাংলাদেশের মুসলমানরাও একটু কম মূল্যে সম্পত্তি ক্রয় করে খুশি। ভারতও খুশি। মাঝখানে হিন্দুরা তাদের হাজার বছরের পিতৃভূমি হারিয়ে বুকভরা বেদনা নিয়ে দেশমাতাকে ও অগণিত আত্মীয়-স্বজন, প্রতিবেশী-আপনজনদের ত্যাগ করে নতুন দেশে নতুন পরিবেশে অজানা নিরাপত্তার উদ্দেশ্যে পাড়ি জমায়। যতটা কষ্ট পাওয়ার তা শুধু বাংলাদেশের হিন্দুরাই পায়।
বাংলাদেশের রাজনীতিতেও হিন্দুরা অপাংক্তেয়। এখন কেউ হিন্দুদের গোণে না। হিন্দুরা একটা ভোট ব্যাংক হয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সাথে দেন-দরবার করে নিজেদের দাবি আদায় করে নেওয়ার কোনো যোগ্যতা রাখে না। একটি দলের কাছেই নিজেদের সবকিছু সমর্পণ করে চোখ বন্ধ করে বসে আছে। স্বাধীনতার ৫০ বছরেও এদেশের হিন্দুদের একটি দাবিও পূরণ হয়নি। কারণ, একদল মনে করে এরা আমাদের ভোট দেয় না, এদের জন্য কিছু করে লাভ নেই। আরেকদল মনে করে, এদের মারলেও আমাদের ভোট দেবে, কাটলেও আমাদের ভোট দেবে, দেশে থাকলে ভোট আমার, দেশত্যাগ করলে জমি আমার। সুতরাং হিন্দুদের রাজনৈতিক গুরুত্ব দেওয়ার বিন্দুমাত্র প্রয়োজন বোধ করে না কোনো দল।
বাংলাদেশের রাজনীতি বা অর্থনীতিতে যা-ই ঘটুক না কেন, ভারত সর্বদা নিজেদের স্বার্থই দেখবে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের হিন্দুদের নিয়ে চিন্তার কোনো প্রয়োজনই নেই, এবং চিন্তা করেও না ভারত।
বাংলাদেশের হিন্দুরা যদি ভাবে, ভারত তাদের বাঁচাবে, তাহলে তারা বোকার স্বর্গে বাস করছে। নরেন্দ্র মোদীর বাংলাদেশে এসে যশোরেশ্বরী মন্দির বা ওড়াকান্দি ধাম ভ্রমণ করা তার রাজনৈতিক এজেন্ডা ছিল মাত্র। এর সাথে বাংলাদেশের হিন্দুদের কল্যাণের কোনো সম্পর্ক নেই। আজ পর্যন্ত নরেন্দ্র মোদী বা বিজেপি সরকারের কোনো দায়িত্বশীল শীর্ষ নেতা বাংলাদেশের হিন্দুদের নিয়ে একটি বাক্যও খরচ করেনি। কারণ, সবার আগে তাদের নিজেদের স্বার্থ, তারপর অন্য কথা।
বাংলাদেশের অনেক হিন্দুরই আত্মীয়-স্বজন ভারতে থাকেন। অথচ এদেশে হিন্দুরা যখন নির্যাতিত হয়, তখন সেই আত্মীয়-স্বজনও কখনো টু-শব্দ উচ্চারণ করে না। সেদেশে কোনো বিক্ষোভ প্রদর্শন, সংহতি প্রকাশ তো দূরের কথা সামাজিকমাধ্যমে একটা বাক্য লিখেও সহানুভূতি প্রকাশ করে না। হ্যাঁ, তারা এমনই নপুংসক ও স্বার্থপর। তবে তারা চুপিচুপি এদেশের হিন্দুদের ভারতে চলে যেতে উৎসাহিত করে। কারণ, তাতে তাদের বিন্দুমাত্র হলেও স্বার্থ আছে। বিনাস্বার্থে তারা পরম আত্মীয়কেও খুব একটা সাহায্য করতে আসে না। শুনতে খারাপ শোনালেও লেখকের ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা এমনই। তাই বাংলাদেশি হিন্দুদের অবশ্যই ভারতমুখিতা ত্যাগ করতে হবে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য হিন্দু-মুসলমান কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে মুক্তিযুদ্ধ করেছিলেন। সেসময় বেছে বেছে হিন্দু গ্রামগুলোতে পরিকল্পিত গণহত্যা চালানো হয়েছিল। সে অর্থে, ত্রিশ লাখ শহিদের মধ্যে সিংহভাগই রক্ত দিয়েছেন এদেশের হিন্দুরা। এটা আমাদের রক্তের বিনিময়ে কেনা দেশ। স্বদেশে যে সুখ, তা কখনো বিদেশে পাওয়া যায় না। প্রিয় স্বদেশেই হিন্দুদের বুক চিতিয়ে বাঁচতে হবে।
তাহলে বাংলাদেশের হিন্দুদের করণীয় কী? বাংলাদেশি হিন্দুর ভাগ্যের নিয়ন্তা একমাত্র তারা নিজেরাই। কোনো বিদেশি শক্তি বা দৈব শক্তি তাদের বাঁচাতে আসেনি, আসবেও না। হিন্দুদের আত্মশক্তিতে বলীয়ান হতে হবে। দেশত্যাগ কোনো সমাধান নয়। তাদের স্বদেশেই থাকতে হবে। মাতৃভূমিতে মাথা উঁচু করে বাঁচতে হবে। হ্যাঁ, এদেশে হিন্দুবিদ্বেষী সাম্প্রদায়িক শক্তি বৃদ্ধি পাচ্ছে, এ কথা ঠিক। কিন্তু একই সঙ্গে উদারপন্থী মুসলমানের সংখ্যাও নেহাত কম নয়। একটি দেশের সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের সহযোগিতা ও সহমর্মিতা ছাড়া সেদেশের সংখ্যালঘুদের বেঁচে থাকা সম্ভব নয়। হিন্দুদের অবশ্যই উদারপন্থী মুসলমানদের সহযোগিতা নিয়ে মিলেমিশেই টিকে থাকতে হবে, সংগ্রামে সঙ্গী হতে হবে। খেয়াল রাখতে হবে, বন্ধুত্ব হয় সমানে সমানে। সবলে-দুর্বলে বন্ধুত্ব হয় না, যেটা হয় তা হলো, একজন অপরজনকে সর্বদা করুণা করে, দয়া করে, সেটা প্রকৃত প্রস্তাবে বন্ধুত্ব নয়। তাই হিন্দুদের অবশ্যই রাজনৈতিকভাবে বলিষ্ঠ অবস্থান নিতে হবে। ন্যায্য দাবি আদায়ে আপোষহীন নেতৃত্ব দিতে হবে। এক্ষেত্রে ভারতীয় মুসলমানরা বাংলাদেশী হিন্দুদের জন্য অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত। ফিলিস্তিনের মুসলমানরা স্বদেশপ্রেমের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। অন্যদিকে ইহুদিরা সংখ্যায় কম কয়েও কীভাবে জ্ঞান-বিজ্ঞানে, অর্থনীতিতে এগিয়ে গিয়েছে, সেটাও এদেশের সংখ্যালঘু হিন্দুদের জন্য অনুকরণীয়।
বাংলাদেশে হিন্দুরা অর্থনৈতিকভাবেও অনেক দুর্বল। তাদের অবশ্যই আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে আরো মনোযোগী হতে হবে। অপচয় কমিয়ে গঠনমূলক ক্ষেত্রে বিনিয়োগ করতে হবে। অন্ততপক্ষে তিনটি সন্তান নিতে হবে। অধিক অধিক কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে হবে। কেউ যেন বেকার না থাকে, কেউ যেন দেউলিয়া না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। একজনের বিপদে অন্য সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। স্বধর্মের প্রতি আরও শ্রদ্ধাশীল হতে হবে। কিন্তু হিন্দুত্ববাদী উগ্র চেতনা অবশ্যই ত্যাগ করতে হবে। আর অবশ্যই উদার মুসলমান বন্ধুদের সঙ্গে মিলেমিশে থাকতে হবে।
বাংলাদেশে মুসলমানদের সহযোগিতা ছাড়া হিন্দুদের টিকে থাকা সম্ভব নয়। তবে সেই সহযোগিতা যেন করুণার না হয়, বরং মুক্তিযুদ্ধের চেতনার অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র বিনির্মাণ এবং বাঙালি সংস্কৃতি রক্ষার স্বার্থেই হয়।
লেখক: মাণিক রক্ষিত
সাংবাদিক ও মানবাধিকারকর্মী