মা দুর্গা মহাশক্তির প্রতীক। সমস্ত দেব-দেবীর সম্মিলিত তেজপুঞ্জ হতে দেবী দুর্গার আবির্ভাব। অশুভ শক্তিকে পরাস্ত করে সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠা করাই দেবী দুর্গার বৈশিষ্ট্য। অনন্য শক্তির প্রতীক দুর্গতি হতে জীবকে রক্ষা করেন বলেই তিনি দুর্গা।তাঁর মহিমা জানলেই বুঝা যাবে

সকল জীবই শিব,তাঁর মধ্যে জাত-কূল,উঁচু -নীচু,ব্রাহ্মণ,শুদ্র,ধনী, দরিদ্র কোন প্রভেদ নাই বলেই তিনি প্রতি বছর সবার ঘরেই আসেন।চার বর্ণের প্রতীক মা দুর্গার সন্তান সরস্বতী(ব্রাহ্মণ),কার্তিক (ক্ষত্রিয়),লক্ষী(বৈশ্য) এবং গণেশ(শুদ্র)হয়েও সকলে একই মায়ের সন্তান।এক পরিবারে চার বর্ণের কি অপূর্ব মিলন।তাই দুৃর্গাপূজা হিন্দুর সার্বজনীন পূজা।মাতৃভাবে অসীমকে আরাধনা।মা দুর্গা বাংলাদেশের চিরায়ত আবহমান রীতি অনুযায়ী সমাজের আর দশজন মহিলার মত মাত্র তিন দিনের জন্য ছেলে-মেয়ে নিয়ে স্বামীর বাড়ি থেকে পিতার বাড়িতে বেড়াতে এসে প্রতিবেশী তথা এলাকার মানুষের সার্বিক অবস্থা জেনে তার থেকে পরিত্রানের পথ দেখান।
 
ইদানিংকালে মাতৃরূপিনী মায়ের জাতের সম্ভ্রম যেভাবে লাঞ্ছিত হচ্ছে তার থেকে পরিত্রাণ পেতে দুর্গা মায়ের পূজার তাত্ত্বিক দর্শন আমাদের সমাজ জীবনে আরো সার্বজনীন হওয়া উচিত।
 
দুৃর্গাপূজার সূচনা পর্যালোচনায় দেখা যায় চন্দ্র বংশীয় রাজত্বে সুরথ নামে এক রাজা ছিলেন।তিনি প্রজাদের নিকট খুব প্রিয় ছিলেন।তথাপি শত্রুর সঙ্গে যুদ্ধে পরাস্ত হয়ে মনের দু:খে বনে গমন করেন।পাগলবৎ ভ্রমণ করতে করতে মেধস মুনির আশ্রমে এসে ঠাঁই নিলেন।এদিকে সমাধি বৈশ্য নামক অপর এক হতভাগ্য ব্যক্তি আত্মীয়-পরিজন কর্তৃক বিতাড়িত হয়ে দৈবযোগে একই আশ্রমে এসে উপনীত হন।অল্প সময়েই উভয়ের মধ্যে হৃদ্যতা হয়ে যায়।তারা মেধস মুনির নিকট প্রত্যেকের দুর্ভাগ্যের বর্ণনা করে তার থেকে পরিত্রাণ কামনা করেন।মুনিবর উভয়কে মহাশক্তি মহামায়ার আরাধনা করতে পরামর্শ দেন।মহামায়া দুর্গা আরাধনায় সন্তুষ্ট হয়ে তাদের মনোবাসনা পূর্ণ করেন।সে থেকে পৃথিবীতে দুর্গতি থেকে মুক্তি লাভের নিমিত্তে দুৃর্গাপূজার প্রচলন হয়।বসন্তকালে এই পূজা অনুষ্ঠিত হওয়ায় তাকে বলা হয় বাসন্তী পূজা।
 
শ্রীরামচন্দ্র রাবণ বধ ও সীতাকে উদ্ধারের নিমিত্তে শরৎকালে দেবীকে অকালবোধন করে অভিষ্ঠ সিদ্ধিলাভ করেন।পরবর্তী কালে শরৎকালের পূজাই শারদীয় দুৃর্গাপূজায় রুপান্তরিত  হয়।অতপর ১৫৮০ খ্রীস্টাব্দে বাংলাদেশের রাজশাহী জেলার তাহেরপুরের রাজা কংস নারায়ণ সর্বপ্রথম দুৃর্গাপূজার প্রচলন করেন।তখন থেকেই শরৎকালের এই দুৃর্গাপূজা বাঙ্গালীর শ্রেষ্ঠ উৎসব হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে।
 
এক সময় দুৃর্গাপূজা ছিল রাজ-রাজড়া ও জমিদার শ্রেণীর লোকের পূজা।তাদের অর্থ সম্পদের অভাব ছিলনা।নিজেদের একক নেতৃত্বে পূজা অনুষ্ঠিত হতো। সাধারণ প্রজাগণের প্রসাদগ্রহণ ব্যতীত পূজায় অংশগ্রহণের কোন সুযোগ ছিল না।এ হেন অবস্থায় জগৎ জননী মা ব্যাথিত হয়ে রাজাদের আঙ্গিনা ছেড়ে আশ্রয় নিলেন বারোজাতের পূজা মন্ডপে। যাকে বলা হতো বারোয়ারী পূজা।ক্রমে ক্রমে আরো সংস্কার হয়ে বর্তমানে বর্ণ,গোত্র,ধনী,দরিদ্র,শিক্ষিত, অশিক্ষিত নির্বিশেষে সকল পেশার মানুষের অংশগ্রহণের মাধ্যমে রুপ নেয় সার্বজনীন দুর্গোৎসবে।এবার মা দুর্গার কাঠামো সম্পর্কে আধ্যাত্মিক বিশ্লেষণে না গিয়ে বাস্তব অবস্থার কিছু অনাবিষ্কৃত বৈশিষ্ট্যের উল্লেখ করতে চাই।একটু গভীর ভাবে অনুধাবন করলে দেখা যায়-মা দুর্গার কাঠামোতে তিনটি চিত্র দ্বারা মানুষকে শিক্ষা দিতে চায়।যেমন পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় চিত্র।
 
বাঙ্গালী তথা বঙ্গদেশীয় যে কোন ধর্মের বিবাহিত  নারীগণ নিজ পুত্র-কন্যা সহ প্রধান ধর্মীয় অনুষ্ঠানে যোগ দেবার উদ্দেশ্যে পিত্রালয়ে আগমন করে থাকেন।সাধারনত পরিবার প্রধান অর্থাৎ স্বামীর সাংসারিক কর্মের ব্যস্ততার কারণে
একসঙ্গে আসা সম্ভব হয়ে উঠেনা। স্বামী বা পিতা বাড়িতে থেকে যাওয়ায় শুধু তার চেহারা চোখে ভাসে আর বার বার মনে পড়ে। তাই কাঠামোতে সবার উপরে অনেক দূরে বসে আছেন মা দুর্গার স্বামী মহাদেব।
 
এবার পারিবারিক চিত্র হিসাবে যদি কাঠামোকে অনুভব করা যায় তবে মনে হয় এটি একটি পরিবার। সেখানে পরিবার প্রধান মা এবং সঙ্গে তার দুই পুত্র ও দুই কন্যা।সঙ্গে আছে সিংহ আর অসুর। আসুরিক শক্তি প্রতিনিয়ত একটি পরিবারের পেছনে লেগে থাকে। তাকে পরাস্ত করে সত্য প্রতিষ্ঠা দ্বারা ঈশ্বর সান্নিধ্য লাভ হয়।
 
পিত্রালয়ে যাওয়ার পথে মায়ের বাম পার্শ্বে রয়েছেন কন্যা- সরস্বতী। দেবী সরস্বতী জ্ঞান ও বিদ্যার প্রতীক।তার হাতে পুস্তক ও বীণা। সত্য সুন্দর ও সাধনার দ্বারা এক জ্ঞানোজ্জ্বল পরিবেশ সৃষ্টি করা তার ধর্ম।রাজহংস তাঁর বাহন।দুধে জল মিশিয়ে দিলে কেবল দুধ টুকুই সে খেয়ে নেয়।অর্থাৎ ভেজাল থেকে ভালোটা গ্রহণ করে নেয়।সে সারাদিন জলে থাকে কিন্তু তার গায়ে জল লাগেনা। যে ছেলে বা মেয়ে অধ্যাবস্যায়ী হয়ে জীবনে প্রতিষ্ঠিত হতে চায় সে সমাজের ভালোটা চায় আর খারাপটা বর্জন করে। সে ইঙ্গিতই কাঠামোতে আছে। সরস্বতী দেবীর বাহন কোন দেবতা নয়। তাত্ত্বিক দর্শনটি বুঝানোর সুবিধার্থে এই উদাহারন
 
মায়ের বাম পার্শ্বে আরো রয়েছেন পুত্র কার্তিক। তিনি ক্ষাত্রশক্তির প্রতীক। কামশক্তিকে দমন রেখে শৌর্য -বীর্যকে প্রতিষ্ঠিত করে পরিবার রক্ষার শক্তি অর্জন করেন। কার্তিকের মত সুঠাম
দেহের পুত্র লাভের জন্য মহিলারা কার্তিক ব্রত করেন। কার্তিকের বাহন ময়ূর। ময়ূরের পেখম খুব সুন্দর। উহা কাজে লাগায় সর্পের সহিত যুদ্ধে। সর্প হিংস্রতার প্রতীক। হিংস্রকে দমন করতে তাই ময়ূরের মত পারদর্শী যোদ্ধার প্রয়োজন। সমাজ জীবনে প্রতি পরিবারে বা মহল্লায় কার্তিকের মত বীর সন্তানের প্রয়োজন।কার্তিকের বৈশিষ্ট্যকে সহজে উপলব্ধি করতে ময়ূর কে বাহন করা হয়েছে। সে ও দেবতা নয়।
 
মায়ের ডানপার্শ্বে রয়েছেন পুত্র গণেশ।তিনি গণ দেবতা বা জনপ্রতিনিধির প্রতীক।কর্মই তাঁর ধর্ম।কর্ম ছাড়া তিনি থাকতে পারেন না। গণেশের মাথা হাতির আর পায়ের নিচে ইঁদুর। হাতির মাথা দ্বারা সমাজের বিত্তবান ও উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন সমাজকে বুঝানো হয়েছে। ইঁদুর নিকৃষ্ট প্রাণীর প্রতীক। আমাদের সমাজ জীবনেও অনেক দরিদ্র প্রতিবন্ধী ও অসহায় মানুষের বাস।একজন গণপ্রতিনিধি যেমন সমাজের বিত্তবানদের সহিত যোগাযোগ রাখেন তেমনি অসহায় সাধারণ মানুষের পাশে সর্বদা বিরাজ করেন।তাই হাতির মাথা ও ইঁদুর দ্বারা গণেশের বৈশিষ্ট্যকে প্রকাশ করা হয়েছে। হিন্দু দোকানে গণেশের ছবি রাখা হয়।উদ্দেশ্যে ছোট – বড় যত বেশি ক্রেতা আসবেন দোকানের বিক্রয় তত বাড়বে। তাই  সব ক্রেতাকে ত্বরিৎ সেবা দিলে ব্যবসার উন্নতি। ইঁদুর গণেশের বাহন।সেও কখনো নীরবে বসে থাকেনা।সর্বদা কাছে যা পায় তাই কাটতে থাকে।গণেশ দেবতার বৈশিষ্ট্য কে সহজে প্রকাশ করার জন্যই ইঁদুর কে বাহন করা হয়।সে ও দেবতা নয়।
 
মায়ের ডানপাশে আছেন লক্ষী দেবী।তিনি ধন ও ঐশ্বর্যের প্রতীক। যার টাকা ও সম্পদ নাই সে লক্ষী হীন। আবার যার চরিত্র নাই সে লক্ষী ছাড়া। তিনি ধন উপার্জন করে সংসারকে স্বাবলম্বী রাখেন।অর্থ সম্পদ ছাড়া কেহ প্রতিষ্ঠিত হতে পারে না। তাই প্রতিটি পরিবারে অন্তত একজন লক্ষী দেবীর মত নারী থাকা প্রয়োজন।পেঁচক তাঁর বাহন।সে দিনের বেলায় চোখ বুজে থাকে।আর রাতের বেলায় খাবার সংগ্রহে বের হয়। কারণ ঢাক-ঢোল পিটিয়ে কেউ অর্থ উপার্জন করে না। উপার্জন করে নীরবে।অর্থাৎ খরচের ব্যাপারে কৃপণ আর উপার্জনের ব্যাপারে পরিশ্রমী।লক্ষী যুক্ত নারী বা পুরুষ গণ উপার্জিত অর্থ বা সম্পদ হতে প্রতিদিন কিছু কিছু সঞ্চয় করে থাকেন।এই অভ্যাস চালিয়ে গেলে একদিন দেখা যাবে অনেক সম্পদের মালিক হয়েছেন। তাই পেঁচক কে লক্ষী দেবীর বাহন করা হয়েছে। সে ও দেবতা নয় উপমা মাত্র।
 
পেঁচক মনুষ্য সমাজকে আরো একটি বিষয় শিক্ষা দেয়।সে সাধক ব্যক্তিকে বলে- সাধারণ মানুষ যখন দিনের বেলায় ঘুমায়।তখন আমার মতো জেগে থাকো।আর মানুষ দিনের বেলা যখন জেগে কাজ করে তখন আমার মতো ঘুমিয়ে থাকো।কারন সাধন জগতে নির্জন রাত্রি কালই শ্রেষ্ঠ।
 
উপরে বর্ণিত পারিবারিক চিত্রে দুর্গা মায়ের মতো এমন একজন আদর্শ গৃহিনী ও সফল মাতা যদি একটি পরিবারে থাকেন আর তাঁর গর্ভে কার্তিক,গণেশ,লক্ষী ও সরস্বতীর মত সন্তান জন্ম নেয়ার পর তাদের কে নিজ নিজ বৈশিষ্ট্যে প্রতিষ্ঠিত করা যায় তবে সে পরিবারটি হবে আদর্শ ও সর্বজননন্দিত।
 
এখন মা দুর্গার কাঠামোতে যদি সামাজিক চিত্র কল্পনা করা যায় তবে দেখা যাবে একটি এলাকায় যদি ১৫/২০টি অনন্য পরিবার সৃষ্টি হয় তবে সে সমাজ বা এলাকা সর্ব বিষয়ে উন্নতির শীর্ষে পৌঁছাবে সন্দেহ নেই।
 
সর্ব শেষে কাঠামোতে রাষ্ট্রীয় চিত্র আবিষ্কার করতে গেলে দেখা যায় একটি দেশে লক্ষীর আদর্শের অনুকরণে প্রজাগণ সম্পদশালী হয়ে দেশের অর্থনীতি সুদৃঢ় হয়।সরস্বতীর আদর্শ অনুসরণ করে দেশে উচ্চশিক্ষিত ব্যক্তি,বৈজ্ঞানিক, সাহিত্যিক সৃষ্টি হয়ে সে দেশ সারা বিশ্বে নমস্য হবে।কার্তিকের মত শক্তিশালী ও সুগঠিত সেনাবাহিনী থাকলে সে দেশে কোনদিন বহিরাক্রমণ হবে না।গণেশের মত একজন পরিশ্রমী জনদরদী রাষ্ট্রনায়ক যিনি উচ্চ-নীচ,ধনী -গরীব নির্বিশেষে সকলের সঙ্গে গণসংযোগ রেখে রাষ্ট্র পরিচালনা করার যোগ্যতা রাখেন তিনি।বর্তমান কালের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার আদর্শ উদাহরণ। অতএব দুর্গা মায়ের কাঠামোতে একটি আদর্শ ও উন্নত রাষ্ট্র গঠনের উপায়সমূহ লুক্কায়িত আছে।
 
মা দুর্গা তিনদিন পিতৃগৃহে অবস্থানের সময় অসুর শক্তির সঙ্গে যুদ্ধ করে পরাস্ত করে শুভ শক্তির সূচনা করেন।অত:পর বিজয়ার দিনে পুনরায় স্বামীগৃহে প্রত্যাবর্তন করেন।আমরা মাকে বিসর্জনের মাধ্যমে বিদায় দিয়ে গঙ্গা স্নানের দ্বারা বিগত বৎসরের সমস্ত পাপ,হিংসা,অবিচার,অনাচার ধুয়ে মুছে পবিত্র হয়ে প্রতিজ্ঞা করি —আগামীতে আমরা ধর্ম, বর্ণ,গোত্র নির্বিশেষে সকলে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে সুন্দর সমাজ গড়ব।দেশ হবে সমৃদ্ধশালী। তবেই কেবল মায়ের আশীর্বাদ বর্ষিত হবে।সে দিকেই আমাদের সকলের চেষ্টা থাকা উচিত।ওঁ সর্বে ভবন্তু সুখিন।
 
 
 
নিরঞ্জন বর্মন
প্রধান সমন্বয়কারী
সনাতন সমাজ বাংলাদেশ