‘’আমার ৪ দশকের বাদ্যযন্ত্র গানের খাতা-নথিপত্র পুড়াইয়া করেছে ছাই
মনের দুঃখ কার কাছে জানাই?

ও ভাই গো ভাই আমার দোষ কি শুধু গান গাওয়া
না ভাটির দেশে উজান বাও‌য়া?
কোন দোষেতে শাস্তি পাইলাম একবার শুধু জানবার চাই?

চোখের সামনে এহেন কান্ড আমার ঘরবাড়ি হয় লণ্ডভণ্ড
আসমান তলে হইল ঠাই মনের দুঃখ কার কাছে জানাই।

ও ভাই লো ভাই
গুরু আমার আব্দুল করিম বলেছিলেন গানে গানে
মানুষ ভজো পরম খোঁজ সুরেই তারে কাছে আনে।
আজকে তারে স্মরণ করি গানের কথা খুইজা মরি!
মুখে কোন ভাষা নাই।
ও ভাই গো ভাই মনের দুঃখ কার কাছে জানাই।’’

এই গানটি কাঁদতে কাঁদতে গেয়েছেন বাউল রণেশ ঠাকুর।গানটি গাওয়ার দুদিন আগে তাঁর সঙ্গীতের ঘরটি পুড়িয়ে ছাই করে দিয়েছে দুর্বৃত্তরা। পুড়ে গেছে তাঁর চল্লিশ বছরের সঙ্গীত সাধনার বাদ্যযন্ত্র, তাঁর একতারা দোতারা, তাঁর ঢোল হারমোনিয়াম, তাঁর গানের খাতাপত্র। এই ঘরটিতে বসে দূর দূরান্ত থেকে আসা ভক্তদের তিনি বাউল গান শেখাতেন। নিজে তিনি গান লিখতেন, সুর করতেন, গাইতেন। বাউল সম্রাট শাহ আবদুল করিমের গানও তিনি গাইতেন, ভক্তদের সেসবও শেখাতেন। শাহ আবদুল করিম বেঁচেছিলেন রণেশ ঠাকুরের গানে। সুনামগঞ্জের দিরাই থানার উজান্ধল গ্রামে রণেশ ঠাকুরের বাড়ি। বাউল সম্রাট শাহ আবদুল করিমের পড়শি তো ছিলেনই, প্রধান শিষ্যও ছিলেন তিনি। রণেশের ভাইও ছিলেন করিমের শিষ্য। বাউলের ঘরবাড়ি আজ ভষ্মীভূত।

দুর্বৃত্ত কারা, তা নিশ্চয়ই যে কোনও সুস্থ সচেতন মানুষই অনুমান করতে পারে। আমাদের দ্বিধা নেই বলতে যে শিল্পসঙ্গীত-বিরোধী ইসলামী মৌলবাদীর দল এই অপরাধটি করেছে। সম্ভবত তারা হিন্দু বিরোধীও। যদিও রণেশ ঠাকুর হিন্দু- মুসলমানের বন্ধুত্ব নিয়ে গান গেয়েছেন, লালনের মতো জাতপাত তিনিও মানতেন না, ধর্মের বিভেদ নয়, মানবতার জয়গানই ছিল তাঁর আদর্শ, কিন্তু তাঁকে হিন্দু হওয়ার অপরাধে শাস্তি দিয়েছে অসহিষ্ণু বর্বর লোকেরা।

ধংসস্তূপ কি ব্যক্তি রণেশ ঠাকুরের সঙ্গীত-কক্ষের ধংসস্তূপ? আসলে সেটি বাংলা সংস্কৃতির ধীরে ধীরে ধংস হয়ে যাওয়ার চিহ্ন। ইসলাম যদি নৃত্য, সঙ্গীত, শিল্প, ভাস্কর্য, সব কিছুরই বিরুদ্ধে, এবং ধর্মান্ধরা যদি সেটিই প্রতিষ্ঠিত করতে চায়, সরকার এবং সমাজ থেকে তারা যদি কোনও বাধা না পায়, তবে আজ হোক, কাল হোক, সেই সমাজই বাংলাদেশে তৈরী হবে, যে সমাজে কোনও প্রাণীর ছবি আঁকা হবে না, কেউ নাচবে না, কেউ গাইবে না, কেউ সিনেমা তৈরি করবে না, কেউ ভাস্কর্য গড়বে না। একসময় তো ধর্মান্ধগুলো রেডিও টেলিভিশনের বিরুদ্ধে ছিল। এখন ওতে সুবিধে হবে না বলে রেডিও টেলিভিশনকে আঁকড়ে ধরেছে।কম্পিউটার, ইন্টারনেটকে আঁকড়ে ধরেছে। অমুসলিমদের আবিষ্কৃত যন্ত্রে ওদের এখন আর আপত্তি নেই। মোবাইল ফোনের বিরুদ্ধে থাকার কথা ওদের। কিন্তু সুবিধে হবে না বলে এটিকেও আঁকড়ে ধরেছে। বিজ্ঞানের আবিষ্কৃত এইসব যন্ত্রকে ওরা এখন নিজেদের ধর্ম প্রচারের উদ্দেশে ব্যবহার করে । শুধু ধর্ম প্রচারের উদ্দেশে নয়, কেউ কেউ তো এসবকে ব্যবহার করে সন্ত্রাসবাদ ছড়ানোর কাজে, সন্ত্রাসী কাজকর্ম পরিচালনা করার কাজে।

লালন শাহকেও জীবিত থাকাকালীন মৌলবাদিদের অত্যাচার সহ্য করতে হয়েছিল। শাহ আবদুল করিমকে হয়েছে। বাউল শিল্পী শরিয়ত বয়াতিকে জেলে পোরা হয়েছে, রিতা দেওয়ানকে হেনস্থা করা হয়েছে। কট্টর মৌলবাদিরা চিরকালই উদারনৈতিক সুফি মতবাদের বিরুদ্ধে। বিশ্বখ্যাত উচ্চাংগ সংগীত শিল্পী আলাউদ্দিন খাঁর স্মৃতি জাদুঘরও পুড়িয়ে ছাই করেছে। অনুমান করতে কারও অসুবিধে হওয়ার কথা নয় যে কারা রণেশ ঠাকুরের সংগীতঘরটি পুড়িয়েছে। নিশ্চয়ই তারা পুড়িয়েছে যারা ঢাকার অদূরে লালন শাহের ভাস্কর্যটি ভেঙ্গে ফেলেছিল। তারাই যুগে যুগে বাংলা ভাষাকে, বাংলা সংস্কৃতিকে নিশ্চিহ্ন করার জন্য রাজনীতি করছে। এ ইসলাম নয়, এ ইসলামের রাজনীতি। এই রাজনীতির উদ্দেশ্য হলো, ইসলামের সংস্কৃতি ছাড়া আর কোনও সংস্কৃতি কোনও মুসলমানের দেশে টিকে থাকবে না। ধর্মান্ধ মুসলমান ছাড়া কোনও প্রগতিশীল মানুষ, কোনও মুক্তচিন্তায় বিশ্বাসী, কোনও ধর্ম সংস্কারক, কোনও আধুনিক মননশীল মানুষের সে দেশে ঠাঁই নেই।

আমি আগে বাঙালি মুসলমানদের 'বাঙালি' বলতাম, এখন আর বলি না। এরা বাঙালি জাতিপরিচয় অনেক আগেই বিসর্জন দিয়ে বসে আছে। আমি এদের বলি 'বাংলাদেশি, বাংলাদেশি মুসলমান'। বাংলাদেশের মুসলমানরা না বাংগালি হতে পারছে, না আরবীয় হতে পারছে। এরা ধীরে ধীরে একটি নামপরিচয়হীন জীবে পরিণত হচ্ছে। কাবা যদি এদের শহরে থাকতো, কাবাকে কি এরা কোনও দুর্যোগে দু:সময়ে কখনও বন্ধ করতো? কাবার সামনে ভিড় করা বা হজ উমরাহ কি বন্ধ করতো? অবশ্যই না। কেউ বন্ধ করতে চাইলে তাকে ঠান্ডা মাথায় খুন করতো। রওজা শরিফ জিয়ারত কি কোনও কারণে বন্ধ করতো এরা? প্রশ্নই ওঠে না। সৌদি আরবের কর্তারা কিন্তু সব বন্ধ করে দিয়েছেন করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ বন্ধ করার উদ্দেশে। তাঁরাও এতটা মৌলবাদি নন, যতটা মৌলবাদি বাংলাদেশের মুসলমানেরা। সৌদি আরবে রোজা শেষ হওয়ার পরদিন থেকে পাঁচদিনের জন্য কার্ফু জারি করা হয়েছে। অর্থাৎ ঈদের দিনে কার্ফু থাকবে সৌদি আরবে। কেউ ঘরের বাইরে যেতে পারবে না, কোথাও ঈদের নামাজের জমায়েত হতে পারবে না। বাংলাদেশের মুসলমানেরা অহরহই সৌদি আরবের পোশাক আশাক ভাষা এবং সংস্কৃতির অনুকরণ করছে, কিন্তু ঈদের দিনের কার্ফুর কোনও অনুকরণ চলবে না।

দেশ এক ভয়াবহ পরিণতির দিকে যাচ্ছে। বুদ্ধিজীবীরা একেকজন একেকটা রাজনৈতিক দলের বশংবদ ভৃ্ত্যের ভূমিকা পালন করছেন। নিরপেক্ষ নির্ভীক কণ্ঠস্বর আজ বিলুপ্ত। বর্তমান সরকার দেশটিকে মূর্খ মৌলবাদিদের কবল থেকে রক্ষা করতে পারতো, সেই সুযোগ তাদের শতভাগ ছিল, কিন্তু সেই সুযোগকে কাজে না লাগিয়ে বরং মৌলবাদিদের আরও ভয়ংকর দৈত্য হতে দিয়েছে। মাদ্রাসাই এখন দেশের বিশ্ববিদ্যালয়, মাদ্রাসা থেকে পাশ করা মৌলবীরাই এখন দেশের পণ্ডিত। এই দেশটির জন্য এখন যা অবশিষ্ট আছে, তা হলো যে কজন অমুসলিম আর প্রগতিশীল চিন্তক দেশে আছে তাদের তাড়িয়ে দিয়ে, অথবা তাদের জন্মের মতো চুপ করিয়ে দিয়ে একশ ভাগ ইসলামী রাষ্ট্র হয়ে যাওয়া, গণতন্ত্র বলে কিছু না থাকা। ইসলামের আদর্শে দেশ চলবে। আল্লাহর আইন অর্থাৎ কোরানের আইন কায়েম হবে। পবিত্র হাদিস অনুসরণ করে সমাজ চলবে।

এই দেশটির পাকিস্তান থেকে আলাদা হওয়ার কোনও কারণ ছিল না। পাকিস্তান থেকে ধ্যান ধারণায় পৃথক হওয়ার যোগ্যতাও এর নেই। আসলে পাকিস্তানের সংগে তুলনাও ঠিক নয়। পাকিস্তানে যত বিপ্লবী আছেন, চিন্তাবিদ আছেন, সচেতন লেখক সাংবাদিক বুদ্ধিজীবী আছেন, বাংলাদেশে তার সিকি পরিমাণও নেই। পাকিস্তানের মৌলবাদিরা পথে ঘাটে, আর সেনাবাহিনীতে। বাংলাদেশের মৌলবাদিরা শুধু পথে ঘাটে আর সেনাবাহিনীতে নয়, তারা সর্বত্র। তারা সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে তো বটেই, তারা সরকারের রন্ধ্রে রন্ধ্রেও।

বাংলাদেশের মৌলবাদিদের মূল শক্তির উৎস কিন্তু ধর্ম নয়, মূল শক্তির উৎস মূর্খতা। ধর্ম যদি উৎস হতো, ধর্ম নিয়ে গবেষণা হতো, ধর্ম নিয়ে গঠনমূলক আলোচনা হতো। মোল্লা মৌলবীরা ভুলভাল বকলে হাতে নাতে ধরতে পারতো কেউ। কিন্তু মোল্লা মৌলবীরা হামেশাই মানবতার বিরুদ্ধে, নারীর বিরুদ্ধে, বিজ্ঞানের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করছে, আর পার পেয়ে যাচ্ছে। কারণ যুবসমাজের মূর্খতাই মোল্লা মৌলবীদের বাঁচায় আর যুবসমাজকে মৌলবাদি বানায়।

হাসিনার ইচ্ছে ছিল মদিনা সনদে দেশ চালানোর। বেঁচে থাকাকালীন তাঁর ইচ্ছে পুরণ হোক। মদিনা সনদের ভিত্তিস্তর তিনি তাঁর শাসনামলে তৈরি করে ফেলেছেন, এখন শুধু তরতর করে মদিনা সনদের ইমারত উঠবে ওর ওপর। কোনও বাউল বা বয়াতি গান গাইবে না, কেউ ঘুঙ্গুর পরে নাচবে না, কোনও নারীবাদী সমানাধিকারের কথা লিখবে না। কোনও বাদ্যযন্ত্র বাজবে না, কোনও মেয়ে বোরখাহীন পথ চলবে না, পাড়ায় পাড়ায় কোনও স্কুল নেই, কলেজ নেই, শুধু মাদ্রাসা, যেখানে আল্লাহর কিতাব মুখস্ত করানো হয়। কোনও বিজ্ঞান গবেষণাগার নেই, কোনও শিল্পকলা একাডেমি নেই, কোনও মিউজিয়াম নেই, চারদিকে শুধু মসজিদ। নামাজ পরার সংস্কৃতিই একমাত্র সংস্কৃতি। ইসলামের ইতিহাসই একমাত্র ইতিহাস।

এমন দিন আসুক। যারা মনে করছে ১৪০০ বছর আগের সমাজ ব্যবস্থাই উত্তম ছিল, সেই সমাজ ব্যবস্থাকে ফিরিয়ে এনে তারা বসবাস করুক। পৃথিবী দেখুক। [ফেসবুক থেকে সংগৃহীত]

লেখক: তসলিমা নাসরিন, নির্বাসিত লেখিকা