মানুষ ধীরে ধীরে অভ্যস্ত হয়ে যাচ্ছে মানুষের অগুনতি করোনা-মৃত্যুতে। মানুষ ঘরবন্দি জীবন আর চাইছে না। পৃথিবীর প্রতিটি দেশেই লকডাউন ভাঙছে মানুষ। সমুদ্র সৈকতে সূর্যস্নান করার স্বাধীনতা বিসর্জন দিতে চাইছে না, সমুদ্রে সাঁতার আর সার্ফিং-এর আনন্দকে চাইছে না ডুবিয়ে দিতে, মদ্যপানের সুখ থেকে নিজেদের বিরত রাখতে চাইছে না, সুস্বাদু খাদ্য ভক্ষণের ইচ্ছে দূর করতে চাইছে না, চমৎকার নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়ায় পার্কে হাঁটা, জগিং করা বা সাইকেল চালানোর দৈনন্দিন রুটিন থেকে নিজেদের বঞ্চিত করতে চাইছে না। জীবনের ঝুঁকি নিয়েও মানুষ চালু করতে চাইছে ব্যবসা-বাণিজ্য, খুলতে চাইছে দোকানপাট, কলকারখানা।

এই স্বাধীনতার মূল্য কি মানুষ দিচ্ছে না? করোনায় আক্রান্ত হচ্ছে, অনেকের মৃত্যুও হচ্ছে। তারপরও স্বাধীনতা বিসর্জন দিতে অনেকেই রাজি নয়। তারা বলছে, কতভাবেই তো মানুষের মৃত্যু হয়, কত রকম ব্যাক্টেরিয়া ভাইরাসে হয়, সড়ক দুর্ঘটনায় হয়, ট্রেন-প্লেন দুর্ঘটনায় হয়, বন্দুকবাজি, বোমাবাজিতে হয়, ক্যানসারে হয়, হৃৎপিন্ডের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে হয়। এগুলো নিত্যদিনের মৃত্যু। করোনায় মৃত্যুর সংখ্যা যত, তার চেয়ে করোনায় তো বেঁচে যাওয়া মানুষের সংখ্যা বেশি। তাই ভয় কেটে গেছে মানুষের। সেই জীবন ফিরে পেতে চায়, যে জীবনটি তারা করোনার আবির্ভাবের আগে যাপন করেছে। চীনের দর্শনীয় স্থানে মানুষ এখন ভিড় করছে, নিউজিল্যান্ডে মৃতের সংখ্যা কম, মানুষ তাই ভিড় করছে রেস্তোরাঁয়, স্পেন দেখেছে করোনা কী করে কেড়ে নিয়েছে শত সহস্র প্রাণ, খোলা মাঠে তারা আজ বেরিয়ে জীবনের উৎসব করছে স্পেনের মানুষ, থাইল্যান্ডে বসে গেছে ফুটপাতের দোকান। মানুষ শ্মশানে পড়ে থাকতে কিছুতেই রাজি নয়। তারা জীবনের স্বাদ গন্ধ পেতে মরিয়া হয়ে উঠেছে।

আমরা কেউ জানি না কী ঘটতে যাচ্ছে। লকডাউন কিছুটা শিথিল করার পর আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা বাড়ছে, মৃত্যুসংখ্যাও বাড়ছে। তারপরও শিথিল একটু একটু করে করতেই হবে, তা না হলে অর্থনীতি ধসে পড়বে, মানুষ না খেয়ে মরবে। এক সময় লকডাউন উঠে গেলে করোনায় আক্রান্তের এবং মৃতের সংখ্যা প্রতিদিন হয়তো প্রচারও হবে না। আমরা জানবোও না কোথায় কজন মারা যাচ্ছে। আড়ালে মৃত্যু ঘটলে আমাদের দুশ্চিন্তাও এখনকার মতো এমন প্রচণ্ড হবে না।

করোনার ভালো একটি টিকা ঠিক কবে নাগাদ হাতে পৌঁছোবে কেউ জানি না। এর মধ্যে প্রচুর মানুষের মৃত্যু হবে। প্রচুর বেঁচেও যাবে। শেষ পর্যন্ত ওই মন্ত্রই আমাদের মেনে নিতে হবে, ‘যে যাওয়ার সে যাবে, যে থাকার সে থাকবে’। করোনায় মৃত্যু হলে আজকাল ঘটা করে সৎকার করারও দরকার পড়ে না। আত্মীয় বন্ধুদের চোখের আড়ালেই মানুষ চিরতরে চলে যাচ্ছে।

করোনা মনে হচ্ছে মানুষকে স্বার্থপর বানাচ্ছে আগের চেয়ে বেশি। যারা ‘করোনায় আক্রান্ত যদি হতে হয় হবো’ বলে লকডাউন অমান্য করে ঘর থেকে বেরোচ্ছে, তারাও কিন্তু প্রিয়জনের মৃত্যু হলে তার কাছে গিয়ে তার মুখটি শেষ বারের মতো দেখছে না, বুকের ওপর লুটিয়ে পড়ে কাঁদছে না। আবেগ নিরুদ্দেশে গেছে। নিশ্চিন্তের জীবন আর কারোর নেই। যে কোনও সময় যে কেউ পিছলে পড়তে পারে, তাই নিজের ক্ষণস্থায়ী জীবনের সুখ আর আনন্দকে মানুষ থাবা দিয়ে ধরতে চাইছে। অন্যের জন্য চোখের জল ঝরতে দিতে এখন অনেকেই রাজি নয়।

ভারতবর্ষে মদ কেনার জন্য যে দীর্ঘ লাইন পড়েছে, কড়া রোদ আর তুমুল বৃষ্টি এলেও সে লাইনের দৈর্ঘ্য এতটুকু কমেনি। ১০০ কোটি টাকার মদ বিক্রি হয়ে গেল একদিনে। মদ্যপানের আনন্দটা কেউ ত্যাগ করতে চাইছে না।

এর মধ্যে হেলিকপ্টার থেকে চমৎকার পুষ্প বৃষ্টি ঘটানো হলো, ডাক্তার আর নার্সদের ধন্যবাদ এবং কৃতজ্ঞতা জানানোর জন্য। কী অসাধারণ সেই দৃশ্য। আমার মনে হচ্ছিল ফুলই কি ডাক্তার আর নার্সদের খুশি করার জন্য এখন সবচেয়ে দরকারী? তাঁদের জীবনের নিরাপত্তার জন্য কি সব উপকরণই হাতের কাছে আছে? তাঁদের সুরক্ষার পোশাক, তাঁদের এন নাইনটি ফাইভ মাস্ক, মাসান্তে করোনার টেস্ট? আমি জানি না কত টাকা খরচ হয়েছে পুষ্প বৃষ্টির পেছনে। ডাক্তার আর নার্সদের তো থালা আর তালি বাজিয়ে কৃতজ্ঞতা জানানোই হয়েছে। করোনার বিরুদ্ধে যে ডাক্তার এবং নার্স জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করছেন, তাঁদের যেন করোনায় আক্রান্ত হতে না হয়, তাঁদের যেন অকাল মৃত্যু না হয়- সেই সুব্যবস্থার পেছনে টাকা ঢালা পুষ্প বৃষ্টির পেছনে টাকা ঢালার চেয়ে বেশি জরুরি। যদি বলা হয় ডাক্তার আর নার্সদের সুরক্ষার ব্যবস্থা পাকা। তাহলে তো ভালো, টাকা যদি হাতে আছেই খরচ করার, তবে ওই অভিবাসী শ্রমিকদের বাড়ি ফেরার ব্যবস্থা পাকা করা উচিত। লকডাউনের আগেই উচিত ছিল। তখন না হলেও এখন করা উচিত। সরকার বলে দিয়েছে শ্রমিকদের ট্রেনের টিকিট কিনতে হবে। কিন্তু হাতে ওঁদের টাকা কোথায় টিকিট কেনার? জম্মু থেকে হেঁটে বিহারে ফিরছেন শ্রমিকেরা। মাথায় বোঁচকা নিয়ে হাজার মাইল হাঁটার প্রস্তুতি নিয়ে। দেখলে অসহ্য যন্ত্রণা হয় মনের কোথাও। মধ্যপ্রাচ্যে, এশিয়ায়, ইউরোপে আটকেপড়া ভারতীয়দের দেশে ফেরত আনার ব্যবস্থা করছে সরকার। এটি চমৎকার উদ্যোগ। যাতায়াতের খরচ যাত্রী দেবেন, সরকার নয়। যাঁরা বিভিন্ন দেশে কাজে কর্মে বা বেড়াতে গিয়ে লকডাউনের কারণে আটকে গিয়েছেন, তাঁদের পকেটে টিকিটের টাকা থাকা স্বাভাবিক, কিন্তু গরিব শ্রমিকদের লকডাউনের কারণে কাজও নেই, বেতনও নেই। তাঁদের কাছ থেকে ট্রেনের ভাড়া চাওয়াটা অমানবিক। মানুষ কি অমানবিক হয়ে উঠছে দিন দিন?

করোনাভাইরাস বিশ্বজুড়ে মানুষকে আক্রমণ না করলে লকডাউনের ঘটনা ঘটতো না। লকডাউনের ঘটনা না ঘটলে গরিবের সংখ্যা এবং তাদের অসহায়ত্বটাও বিশ্ববাসীর দেখা হতো না। এখন আমরা জানি বিশ্বে কারা কেমন আছে। আমরা জানি উন্নত দেশে বাস করলেই চমৎকার স্বাস্থ্যসেবা জোটে না, সকলেই সেখানে নিরাপদ নয়, আমরা জানি তুমি পারমাণবিক অস্ত্র বানাচ্ছ, দেশে কোটিপতির সংখ্যা অনেক, তার মানে কিন্তু এই নয় যে, তোমার দেশে দারিদ্র্য নেই, বা কেউ অভুক্ত নেই। ২০ লক্ষ শিশু ভারতের রাস্তায় বাস করে, তাদের কোনও ঘর নেই, কোনও খাদ্য নেই।

ভালো উদ্যোগও কিন্তু ভারত সরকার নিয়েছে। রেশন কার্ড যাদের আছে, সরকারের পক্ষ থেকে তাদের বিনে পয়সায় রেশন দেওয়া হয়েছে। যাদের রেশন কার্ড নেই, তাদের বিনে পয়সাও রান্না করা খাবারও দেওয়া হয়েছে। অভুক্তকে খাদ্য দেওয়ার, বেকারকে চাকরি দেওয়ার, গৃহহীনকে আশ্রয় দেওয়ার, সবাইকে শিক্ষা দেওয়ার, নিরাপত্তা দেওয়ার এবং স্বাস্থ্যসেবা দেওয়ার পদক্ষেপ যেন প্রতিটি দেশই নেয়, নিয়ে থাকলে করোনার অজুহাতে এ থেকে কোনও দেশই যেন সরে না আসে। করোনা-পরবর্তী বিশ্বকে অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা থেকে যেভাবে রক্ষা করতে হবে, তেমনি মানবিক হতে হবে আগের চেয়ে বেশি। করোনার অভিজ্ঞতা মানুষকে যেন অমানবিক না করে, যেন মানবিক করে আরও। সোশ্যাল ডিস্টেন্সিং মেনে নিলেও মানুষের মধ্যে যেন মানসিক দূরত্ব মেনে না নিই। পরস্পরের প্রতি সহমর্মিতা না থাকলে মানুষ ক্রমশ রোবট হয়ে উঠবে। রোবটের পৃথিবী এক ভয়াবহ পৃথিবী যে পৃথিবীতে বেঁচে না থাকলে আমার সত্যিই কোনও আফশোস হবে না। অনেকেরই হয়তো হবে না।

লেখক: নির্বাসিত বাংলাদেশী লেখিকা