যশোরঃ কতো নিতার কাছে গিলাম সবাই ফিরোয়ে দেচে। লাগবে না আইডি কাড। কি হবে এখন আর আইডি কাড দিয়ে! চার বছর বয়েসে মা মরে গেছে। সৎমার গালিগালাজ শুনিচি ম্যালা। দশ বছর বয়সে এই যশোরে আইচি। বিভিন্ন হোটেলের বাবুর্চির কাজ করিছি। 


মা'রে আড়াল করে বাবা যশোরে আসে টুকটাক খোঁজ খবর নিতো। দেখাশুনা করে আমারে বিয়ে দিয়ার কয়দিন পরেই বাবা মরে গ্যালো। হিন্দুস্থান পাকিস্তান হওয়ার এক বছর পরে আমার ০৩ ছেলে মরে গ্যাচে ডায়রিয়ায়। ওদের বয়স তখন দুই, আড়াই বা তিন বছরের মতো হবে। একটা মেয়ে ছিলো। এখন বেঁচে আছে কিনা জানিনে। মেয়েরে বিয়ে দিছিলাম এক ছেলের সাথে। বিয়ের পরে ওর একটা ছেলে হলো। ছেলে হওয়ার দেড় মাস পরে বাচ্চাটকে নিয়ে আমার কাছে চলে আসলো মেয়ে। খুব কষ্টে মেয়ের নামে একটা বাড়িও কিনিছিলাম আকবরের মোড়ে। ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে মেয়েটাও আমাকে ছেড়ে কোথায় যে চলে গ্যাছে তার খোঁজ আজও মেলেনি। ১১ বছর আগে আমার স্ত্রী মরে গেছে। মেয়ের রেখে যাওয়া দেড় মাসের ছেলেকে বড় করলাম, বিয়ে দিলাম। এখন আমার দুনিয়ায় এই রিক্সা ছাড়া আর আপন বলতে কেউ নেই! 


অতি বিষ্ময়ে এবং ছলছল ছোখে এসব কথাগুলো বলছিলো ৯৮ বছরের তরুণ রণজিৎ। বাঘারপাড়া থানার জামালপুর গ্রামে উনার জন্ম। কোন কোন দিন ৬০ টাকা, ৮০ টাকা, ১০০ টাকা বা ১৫০ টাকা আয় হয় তার। ব্যস্ততম সময়ের অধিকাংশ মানুষই উনার গাড়িতে উঠতে চান না। যা আয় করেন তাই দিয়ে হোটেলে কোন রকম দু'বেলা দুমুঠো খেয়ে দিন পার করছেন তিনি। বাড়ি ঘর হারানোর পরে ১০০০ টাকার ভাড়া বাসায় একা একাই থাকতেন তিনি। ইনকাম ভালো হয় না; তাই ভাড়া করা বাসা ছেড়ে এখন বাসিন্দা হয়েছেন যশোর চৌরাস্তার ন্যাশনাল লাইফ ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেড (এন এল আই টাওয়ার)'র  নিচে। সারাদিন রিক্সা চালানোর পর ওখানেই রাত্রিযাপন করছেন তিনি।


৯৮ বছর বয়সের রণজিৎ প্রায় বলশূন্য, পায়ে রিক্সার প্যাডেল মেরে কিভাবে ভবতারিণী পার হবেন এমনটাই ভেবে হয়ত আগামীর দিনগুলি গুনছেন। 


যেখানে ইঞ্জিনচালিত রিক্সার ভাড়া প্রতিদিন ৪০০-৫০০ টাকা। সেখানে পায়ে চালিত, আবার ৯৮ বছর বয়সী ব্যক্তির রিক্সা, অসার দেহ এবং ভাঙা গাড়িতে বেমানান বর্তমান সময়ের সভ্যতা। ভাববার বিষয় যেটি হলো, উনার বয়স এখন ৯৮ বছর। আর ক'দিন উনি এইভাবে রিক্সার প্যাডেল মেরে উনার বেঁচে থাকার ব্যবস্থা করবেন! উনার নির্দিষ্ট থাকা খাওয়ার বন্দোবস্ত না হলে শেষ সময়ে রাস্তার ফকির বা পাগলের মতো আচরণ সহ্য করতে হবে। শারীরিক সক্ষমতা যখন ভঙ্গুর হয়ে পড়বে তখন উনাকে রাস্তার আবর্জনার মতো এখানে সেখানে গড়িয়ে বেড়াতে হবে। 


সমাজের বিত্তবান মানুষ এবং যারা এই সকল বাবা-মায়েদের নিয়ে কাজ করেন তাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। যদি পারেন তবে উনার একটা ব্যবস্থা করার অনুরোধ করছি। 


কথা হচ্ছিলো বন্ধু শেখ এখতিয়ার বাকি এবং আমার সাথে। উনার অবস্থা দেখে বিভিন্ন বিষয় তথা বয়স্কভাতা পান কিনা এই প্রশ্নে তিনি এসব কথাগুলো অকপটে বলে ফেললেন। চোখে-মুখে বেদনা ও বিরক্তির ছাপ। তাকে একজন বাবা ডেকে এবং তাকে তার বাড়িতে নিয়েও যাবেন বলেছিলেন। আজও আসেননি তাকে বাবা ডাকা সেই ছেলেটি। আমাদের সাথে বলা উনার শেষ কথা, জানিনা এই অসার দেহটাকে কোন্ সন্তান কাঁধে নিয়ে যাবে শ্মশানে...! 



তথ্য ও লেখা: সাধন কুমার দাস 

                      কবি ও সমাজকর্মী