ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর উপজেলার রসরাজ দাসের ফেসবুক, মোবাইল ফোন কিংবা মেমোরি কার্ডে ধর্ম অবমাননাকর কোনো ছবি পায়নি পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) ও পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) ফরেনসিক বিভাগ। তবু এ ধরনের ছবি পোস্ট করার অভিযোগে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে প্রধান আসামি করে তার বিরুদ্ধে অভিযোপত্র দিয়েছে পুলিশ।

ফেসবুক পোস্টের মাধ্যমে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার অভিযোগ তুলে ২০১৬ সালের ৩০ অক্টোবর নাসিরনগরে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের ১৫টি মন্দির ও শতাধিক বাড়ি-ঘরে হামলা, ভাঙচুর, লুটপাট এবং অগ্নিসংযোগ করা হয়।

ওই ঘটনায় রসরাজের বিরুদ্ধে ২০০৬ সালের তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি আইন (সংশোধনী-২০১৩) এর ৫৭(২) ধারায় রসরাজের বিরুদ্ধে মামলা হয়। পরবর্তীতে আইনটি বাতিল হওয়ায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, ২০১৮ এর ২৮, ৩১, ৩৩ ও ৩৫ ধারায় রসরাজ ও জাহাঙ্গীরকে আসামি করে পুলিশ অভিযোগপত্র দিয়েছে।

রসরাজের আইনজীবী মো. নাসির মিয়া জানান, ওই মামলায় গত বছরের ২৯ ডিসেম্বর আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেন জেলা গোয়েন্দা পুলিশের পরিদর্শক মোহাম্মদ ইকবাল হোসেন। তাতে প্রধান আসামি হিসেবে রসরাজসহ উপজেলার শংকরাদহ গ্রামের বাসিন্দা ও যুবলীগ নেতা জাহাঙ্গীর আলমকে আসামি করা হয়।

আদালত সূত্র জানিয়েছে, অভিযোগপত্র জমা দেওয়ার পরের দিন ব্রাহ্মণবাড়িয়ার চিফ জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালত মামলাটি বিচারের জন্য চট্টগ্রামের সাইবার ট্রাইব্যুনালে বদলি করেন। ১২ জানুয়ারি অভিযোগপত্রসহ মামলার নথি ডাকযোগে চট্টগ্রামের সাইবার ট্রাইব্যুনালে পাঠানো হয়। গত ৩০ জানুয়ারি এই ট্রাইব্যুনালে রসরাজের মামলার শুনানির তারিখ ছিল।

রসরাজের পরিবারের সদস্যদের ভাষ্য, তার ফেসবুক, মোবাইল ফোন ও মেমোরি কার্ডের ফরেনসিক প্রতিবেদনে তার আইডি থেকে ওই পোস্ট দেওয়ার কোনো প্রমাণ না পাওয়ার অর্থ হলো, রসরাজ ওই পোস্ট দেননি।

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে জেলা গোয়েন্দা পুলিশের পরিদর্শক মোহাম্মদ ইকবাল হোসেন গণমাধ্যমকে বলেন, 'মোবাইল ফোন ও মেমোরি কার্ডে ছবি পাওয়া না গেলেও রসরাজ তার আইডি থেকে দেওয়া একটি পোস্টে ক্ষমা চেয়ে আবার সেটা ডিলিট করে দিয়েছিল—এমন পোস্টের অস্তিত্ব পেয়েছে ফরেনসিক বিভাগ। ফরেনসিকের সব প্রতিবেদন পর্যালোচনা, সব ডিভাইস পরীক্ষা-নিরীক্ষা, বিশেষজ্ঞদের মতামত, সাক্ষ্য-প্রমাণ ও পারিপার্শ্বিক সব কিছুর ভিত্তিতে ২ জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট দেওয়া হয়েছে।'

তবে কোন পরিস্থিতিতে এবং কেন রসরাজ ক্ষমা চেয়ে পোস্ট দিয়েছিলেন, কেনই বা তা মুছে দিয়েছিলেন তা বলেননি তিনি।

রসরাজ নাসিরনগরের হরিপুর ইউনিয়নের হরিণবেড় গ্রামের জগন্নাথ দাসের ছেলে। তিনি পেশায় জেলে।

২০১৭ সালে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) জমা দেওয়া দুটি তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, রসরাজ দাসের মোবাইল ফোন ও মেমোরি কার্ডে ধর্মীয় অবমাননাকর নমুনা ছবির কোনো অস্তিত্ব পাওয়া যায়নি। বরং গ্রেপ্তার হওয়া জাহাঙ্গীর আলমের মালিকানাধীন আল আমিন সাইবার পয়েন্ট ও স্টুডিওতে ব্যবহৃত কম্পিউটারে ধর্মীয় অবমাননাকর সেই ছবিটি সংরক্ষণের পর এডিট এবং ছবিটি সেখানে কিছু সময় সংরক্ষণের পর মুছে ফেলা হয়। তবে ধর্মীয় অবমাননাকর ছবিটি জাহাঙ্গীরের কম্পিউটার ব্যবহার করে ফেসবুকে পোস্ট করা হয়েছে কি না, সে বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া যায়নি।

সাম্প্রদায়িক হামলার প্রায় ১ মাস পর ২৮ নভেম্বর রাতে ব্রাহ্মণবাড়িয়া শহরের কালাইশ্রীপাড়া থেকে জাহাঙ্গীরকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এরপর ১০ দিনের রিমান্ডে জাহাঙ্গীর পুলিশকে জানান, নাসিরনগরে হামলার পেছনে ফেসবুকের যে ছবিটি, সেটি ছাপিয়ে লিফলেট আকারে বিলি করেছিলেন তিনি।

মামলাটির তৎকালীন তদন্তকারী কর্মকর্তা পুলিশের উপপরিদর্শক (এসআই) মো. ইশতিয়াক আহমেদ জানান, ২০১৬ সালের ৮ ডিসেম্বর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম সুলতান সোহাগ উদ্দিনের আদালতে জাহাঙ্গীর ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দেন। পরে বিচারক জাহাঙ্গীরকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন।

ইশতিয়াক বলেন, ২০১৬ সালের ২৯ অক্টোবর সকালে হরিপুর ইউনিয়নের হরিণবেড় বাজারে শংকরাদহ গ্রামের জুয়েল মিয়া নামে এক যুবকের কাছ থেকে ধর্মীয় অবমাননাকর ছবিটি 'শেয়ার-ইট' অ্যাপের মাধ্যমে নিজের মোবাইল ফোনে নেন বলে জাহাঙ্গীর তার জবানবন্দিতে জানিয়েছেন। এরপর ছবিটি প্রিন্ট করে ওই দিন সন্ধ্যায় লিফলেট আকারে বিলি করা হয়। রসরাজকে ধরে আনার জন্য হরিপুরের ফারুক মিয়া, হাজী বিল্লাল ও কাপ্তান মিয়া তাকে নির্দেশ দিয়েছিলেন।

রসরাজকে জাহাঙ্গীরই পুলিশের হাতে তুলে দিয়েছিলেন।

নাসিরনগরে হামলা, ভাঙচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় মোট ৮টি মামলা হয়। এ ছাড়া, পরিস্থিতি সামাল দিতে ব্যর্থতার দায়ে প্রথমে নাসিরনগর থানার তৎকালীন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ও তৎকালীন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে (ইউএনও) প্রত্যাহার করা হয়। সূত্র: দ্য ডেইলি স্টার

প্রতিবেদক, বাংলাদেশ দর্পণ