মুখ খোলা দু'টি কথা বলতেই হলো

দুর্গা পূজা ভারতবর্ষের জাতীয় মহোৎসব। আমাদের বাংলাদেশ সহ পশ্চিম বঙ্গে পাঁচ দিনব্যাপী এই পূজার অনুষ্ঠান হয়ে থাকে তাই প্রাচীন শিষ্ট সমাজ এই ধর্মানুষ্ঠানকে বলতেন ' কলির অশ্বমেধ '। 

দুর্গতি থেকে মুক্ত করেন বলেই দেবীর নাম দুর্গা।তাই মহাভারতের চক্রবর্তী সম্রাট যুধিষ্ঠির আসন্ন বিপদ থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য বিরাট পর্বের ষষ্ঠাধ্যায়ে দুর্গাদেবীর স্তোত্রে বলেছেন 'দুর্গাৎ তারয়সে দুর্গে তৎ ত্বং দুর্গা স্মৃতা জনৈঃ' এই স্তোত্রে দেবীকে চতুর্ভুজা বলে সম্বোধন করা হয়েছে। শুধু তাই নয় ভগবতী দুর্গা ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে নিজেকে প্রকটিত করেছেন দশভুজা, কোথাও দ্বা দশভুজা,কোথাও আবার অষ্টাদশভুজা রূপে।এই দ্বিভুজ থেকে অষ্টাদশভুজা প্রতিমা ভারতের বিভিন্ন প্রদেশে দেখা যায়। মৎস্য -সুক্তগ্রন্থে " ওড্রদেশে কলিঙ্গে তু মধ্যদেশে তথৈব চ দেবী চাষ্টভুজা পূজ্যা অযোধ্যায়াং সুরাষ্ট্রকে" ইত্যাদি সুক্ত থেকে জানা যায় যে, কন্যাকুমারী থেকে শুরু করে উত্তর পশ্চিম সীমান্তের রামঠ দেশ পর্যন্ত দেবী বিভিন্ন রূপে অধিষ্ঠাতা। 

তবে আমাদের বাঙালী এবং বাংলাদেশের দুর্গাপূজা হলো শরৎকালে মহালয়ার সকালে বীরেন্দ্র কৃষ্ণ ভদ্রের কন্ঠে মহিষাসুরমর্দিনী দিয়ে। আশ্বিনে দেবী কন্যা রূপে শান্ত ভাবে পরিবার নিয়ে তিন দিনের জন্য পিতৃগৃহে আসেন। এই পরিবার নিয়ে আসা উমা মহেশ্বরের পূজা পালবংশীয় রাজাদের সময় থেকেও আরো আগের। মৎস্যপুরনে কাত্যায়নী ' জয়া চ বিজয়া চৈব কার্ত্তিকেয় বিনায়কৌ পার্শ্চয়োর্দর্শয়েৎ তত্র' তখন চারদিকে প্রকৃতি সেজেগুজে আগমনীর গানে প্রস্তুত করে নিজেকে। বাঙ্গালী হিন্দুদের কাছে 'জটাজুটসমাযুক্তাম' দুর্গতিনাশিনী হয়ে যান আমাদের ঘরের মেয়ে উমা।

শিউলি আর কাশফুলে আকাশে উপর দিয়ে যখন ভ্রাম্যমাণ মেঘ উড়ে উড়ে যায় তখন আর পঞ্জিকায় দিন তারিখ দেখতে হয় না পিতৃপক্ষের পিতৃতর্পণ করে শেষ হতে না হতেই দেবীপক্ষ শুরু।তখন মনে হয় দিনগুলে তার সময় কমিয়ে আনে!পাড়ায় পাড়ায় প্যান্ডেলবেঁধে সাজসজ্জা তদারকির চলে চারিদিকে। সারাটা বছরের অপেক্ষা এই পাঁচটা দিন লিখতে গেলে হয়তো সঠিক উপমার ব্যবহার করতে পারবো না!

এতক্ষণে গৌরচন্দ্রিকা শেষ করলাম

এখন আমার বিলুপ্ত প্রায় হিন্দুভ্রাতাদের নিয়া কিছু বলতেই হয়। আমিই বলিব কিংবা আমারই যে বলতে হবে এমন কোন কথা নয়! তবে এখনে আমিই বলতেছি কারন আমাদের হিন্দু স্কলাররা কিছু বলতেছেন না। একেবারেই যে বলতেছেন না তা ডাহামিথ্যা কথা! কেউ কেউ বলতেছেন তাদের দায়িত্ব পালন করতেছেন আবার কেউ কেউ সম্পর্ক নষ্ট হইবে বলিয়া বলেন না।

দেবীর অকালবোধন থেকে শুরু করে বিজয়া দশমীর বিসর্জন সবই বৈদিক মতে হয়ে থাকে তবে আমাদের পূজার প্যান্ডেল গুলো বৈদিক মতে হয় কি? আমাদের দেবীর প্রতিমা কি বৈদিক ভাবে তৈরী করা হয়? মণ্ডপে মণ্ডপে যে থিম করা হয় তা কি আমাদের বৈদিক সংস্কৃতির চিন্তাধারায়? এমনও মণ্ডপ আছে তাদের থিম তৈরি হয় পদ্মা সেতুর মতো! এমনও মণ্ডপ আছে ভিতরে ডুকলে মনে হয় শহরের  নতুন কোন রেস্তোরাঁয় আসলাম! তাদের অধিক থেকে অধিকতর হ্যালুজেন লাইটে আর বড়ো বড়ো সাউন্ড বক্স দেখলে সন্দেহ হয় আমি কি পূজার মণ্ডপে আসছি!! ভ্যাগিস দেবী মায়ের প্রতিমা সামনে থাকে তাই মনে সান্তনা দেওয়া যায়। মায়ের আগমনে আলোকিত হোক পৃথিবীর আলোক সজ্জায় সজ্জিত হোক শহরে গ্রামের রাস্তা ঘাট। তবে মণ্ডপে মণ্ডপে চণ্ডীপাঠ না হয়ে উচ্চ আওয়াজে অবৈদিক গান বাজে কেন? সব গান গুলোকেই আমি বিশ্রী বলছি না তবুও এই গান গুলো কি পূজার মণ্ডপে বাজানো উচিত? 

আমাদের সংস্কৃতির বিরাট একটা অংশ তো গান নিয়ে ভজন কীর্তন মাতৃবন্দনা নিয়ে এখনে কি এতোই অভাব পরে গেলো যে বার গুলোতে গান বাজানো হয় তা বাজাতে হবে? 

অনেক মণ্ডপে দেখা যায় প্রচুর  টাকা খরচ করে অমুক ডিজে তমুক ডিজে আসছেন! আচ্ছা দাদা এই ডিজে পার্টিটা কি পূজোর সময়ই দিতে হব?
আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম কি এই ধারনা নিয়েই বড়ো হবে?  আমাদের অহিন্দু বন্ধুদের কাছে কি এইভাবেই আমাদের ধর্ম সংস্কৃতি উপস্থাপন করবো?

দেবী দুর্গা অসুরকে নাশ করেছিলেন আর আমরা তার সন্তান হয়ে নিজেরাই অাসুরিক কাজ নিয়োজিত! আমাদের পূজায় করা সবচেয়ে বড়ো পাপ হলো সুরা বা মদ! একটু রাত গভীর হলেই মণ্ডপ গুলোতে দেখা যায় মদপ্য হয়ে তান্ডব নৃত্য! বলি কেন পূজোর সময়ই এসব করতে হবে? কেন আমাদের বিসর্জেন পজিশনে মদপান করতে হবে? আমরা অনেকেই হয়তো আমাদের অহিন্দু বন্ধুদের কাছ থেকে শুনে থাকব এই কথা আমার এক অহিন্দু বন্ধু আমাকে বললো মদপান ত তদের কাছে ওপেন তদের পূজায় গেলে দেখাই ত যায় কথাটা মিথ্যে নয় তবে মিথ্যে হলো মদপান আমাদের ধর্মে ওপেন নয় নিষেধ আছে! 

স্থেনো হিরণ্যস্য সুরাং পিবংশ্চ
গুরোস্তল্পমাবসন্ ব্রক্ষহা চৈতে
পতন্তি চত্বার পঞ্চমশ্চাচরং স্তৈঃ।

ছান্দোগ্য উপনিষ ৫/১০/৯

অনুবাদ : সুবর্ণীপহারী,মদপ্য,গুরুতল্পগ,ও ব্রহ্মস্ন এই চার ব্যাক্তি এবং যে পঞ্চম ব্যাক্তি তাদের সংসর্গ করে তারা পতিত হয়।

নকী বেরন্তং সখ্যায় বিন্দমে পীয়ন্তি তে সুরম্বঃ
যদা কৃণোষি নদনুং সমুহস্যাদিৎপিতে হয়সো।।

ঋগ্বেদ ৮/২১/১৪

অনুবাদ :তোমার সুরাপানকারী,নেশাকারী সঙ্গী অথবা বন্ধু যদি সবচেয়ে বিদ্বান অথবা ধনীয় হয় তারপরও বজ্রপাততূল্য এবং অবশ্যই পরিত্যাজ্য।

তবুও বৈদিক পূজায় আমরা কি ভাবে অবৈদিক কাজ করতে পারি? সাত্ত্বিক পূজায় এইসব তামসিক কাজ করে আমরা আমাদের ধর্মকে এইভাবে রিপ্রেজেন্ট করতে পারি না! অলীক অন্ধকার দূর করতে গিয়ে আমরা নিজেরাই নিজেদের তৈরি তমসায় বিসর্জন হতে পারি না।

ভ্রাতাগন এই বিলুপ্ত প্রায় হিন্দু সমাজকে তার বৈদিক সাম্য ও ঐক্যের শামিয়ানায় আনতে হলে সবার আগে আমাদের জাগতে হবে।আমরা কেউই এই অপসংস্কৃতি বাহিরে না! নিজের মনের অজন্তেই আমরা এই তামসিক কার্যকলাপকে সমর্থন করছি না তো?

দুর্গমকে বধ করিয়া যিনি জীবজগতকে দুর্গতির হাত থেকে রক্ষা করেন তিনি মা দুর্গা।

এই দুর্গমাসুরের দুই রূপ। সংসারের পথে এই অসুরের নাম স্বার্থান্ধতা আর আধ্যাত্মিক পথে এই অসুরের নাম অবিদ্যা। এই অবিদ্যার অধীন হয়ে জীব দুঃখ পায় মায়ার খাদে পরে।তাই সন্তানকে বাচাতে মা জ্ঞান অসি দিয়ে অবিদ্যার বন্ধন ছেদ করেন।

আমাদের অবিদ্যার বন্ধন ছেদ হবে কবে?

লেখক: জয় দেবনাথ