মন থাকলেই মন খারাপ! একটি বাংলা ছবির বিখ্যাত সংলাপ। তবে কথাটির কিন্তু গভীর অর্থ আছে। একটু বুঝিয়ে বলছি।

ধরুন সকালে উঠে আপনি রোজকার মতো স্নান-খাওয়া করে অফিস গেলেন। হঠাৎ অফিসে পৌঁছে কোনও কারণ ছাড়াই আপনার ভীষণ মন খারাপ হল। বা এই গোটা বিশ্বের উপর আপনার ভয়ানক রাগ হল। মনে হল সব জ্বালিয়ে পুড়িয়ে শেষ করে দিতে।

আশ্চর্য ব্যাপার হল দু’ঘণ্টা পড়েই আপনার এই মন খারাপ বা বিরক্তি চলে গেল। এখন মানুষের মন বলে কথা। সেখানে কখনও মেঘ আর কখনও বৃষ্টি। তাই এমনটা যে এক আধদিন হতে পারে না সেটা বলছিনা। কিন্তু বারবার হলে বা প্রতিদিন হলে বুঝতে হবে আপনার মুড সুইংয়ের (Mood Swings) সমস্যা আছে। 

মুড সুইং আসলে কী? (What Is Mood Swings)

খুব ঘন ঘন এবং কোনও নির্দিষ্ট কারণ ছাড়া যখন মুডের পরিবর্তন হয় তাকে মুড সুইং বলা হয়। দেখা গেছে যে যাঁদের খুব দ্রুত মুড সুইং হয় সেইসময় তাঁদের মস্তিষ্ক খুব তাড়াতাড়ি সিদ্ধান্ত নিতে পারে এবং সমস্যার সমাধান বা কোনও ভবিষ্যৎ প্ল্যানিং করে ফেলতে পারে। তবে দুর্ভাগ্যজনক বিষয় হল এটা সবার ক্ষেত্রে হয়না। বেশিরভাগ মানুষের ক্ষেত্রেই বারবার মুড পরিবর্তন হওয়া খুব ক্ষতিকর প্রমাণিত হয়েছে।মনোবিদরা আশঙ্কা করেন গোড়ার দিকেই মুড সুইংয়ের (Mood Swings) সমস্যার সমাধান না করতে পারলে সেটা বাইপোলার ডিসঅর্ডার বা দ্বৈত স্বত্বার মতো জটিল ও গভীর মানসিক রোগে পরিণত হয়।

কী কী কারণে হতে পারে মুড সুইং (Common Causes of Mood Swings)

চিকিৎসাশাস্ত্র বলছে আমাদের মস্তিষ্কে কয়েকটি নিউরোট্রান্সমিটার আছে। এগুলি আসলে বিভিন্ন প্রকারের হরমোন। এই নিউরোট্রান্সমিটারের মধ্যে সেরোটোনিন ও নরপাইনফ্রাইন হল খুব গুরুত্বপূর্ণ। প্রথমটি আমাদের ঘুমের প্যাটার্ন, নানা রকমের মানসিক স্থিতি ও আবাগের ওঠাপড়ার সঙ্গে জড়িত। আর দ্বিতীয়টির সম্পর্ক আছে স্মৃতি, কোনও কিছু শেখার দক্ষতা ও শারীরিক চাহিদার সঙ্গে। এই দুটি নিউরোট্রান্সমিটার যদি একটু কম বেশি হয় তাহলে মুড সুইং দেখা দিতে পারে।এছাড়াও মুড সুইং হওয়ার অন্যান্য কয়েকটি কারণ আছে। 

১| স্ট্রেস বা মানসিক চাপ (Mental Stress)

আমাদের প্রত্যেকের মানসিক চাপ নেওয়ার ক্ষমতা একেক রকমের হয়। কেউ একটু বেশি চাপ সহ্য করতে পারে আবার কেউ একটু কম চাপেই ভীত হয়ে পড়ে। অফিস, সংসার, ছেলেমেয়েদের চিন্তা, কেরিয়ার, প্রেম সহ নানা রকমের জটিলতার কারণে স্ট্রেস দেখা দেয়। আর এর থেকেই অনেক সময় মুড সুইং (Mood Swings) হতে পারে।

২| অস্থিরতা বা অ্যাংজাইটি (Anxiety)

কেউ ধীর স্থির হয় আবার কেউ একটু ছটফটে। কিন্তু অনেকেই আছেন যারা প্রত্যেক বিষয়েই অস্থির হয়ে পড়েন। হয়তো বিষয়টি খুব সামান্য, খুব সহজেই তার সমাধান করা সম্ভব তাতেও তাঁরা ভয়ানক চিন্তা ভাবনা শুরু করে দেন। যেমন ধরুন নির্দিষ্ট সময়ে বাস এলনা, ছেলে মেয়ে বা অন্য কেউ বাড়ি ফিরছে না, এসব ব্যাপার তাঁদের অতিরিক্ত ভাবায়। একেই অ্যাংজাইটি বলে। এর থেকেও মুড সুইং হতে পারে।

৩| অবসাদ বা ডিপ্রেশান (Depression)

মনোবিদরা বলছেন মুড সুইংয়ের অন্যতম কারণ হল মানসিক অবসাদ বা ডিপ্রেশান। এটাকে মুড সুইং এর অপর পৃষ্ঠা বলা যেতে পারে। হঠাৎ করে মন খারাপ হয়ে যাওয়া বা গভীর দুঃখের সাগরে ডুবে যাওয়াও কিন্তু মুড সুইংয়ের অন্যতম লক্ষণ। 

৪| মদ্যপান ও অবৈধ মাদক (Drug or Alcohol)

অনেকেই স্ট্রেস, অ্যাংজাইটি ও অবসাদ থেকে বাঁচতে মদ্যপান বা অবৈধ মাদকের সাহায্য নেয়। তাঁরা মনে করেন এগুলি তাঁদের সমস্যার সমাধান করবে।আদতে কিন্তু সেটা হয়না। কারণ এগুলি আপনার শরীরে প্রবেশ করলে সাময়িকভাবে এগুলি স্নায়ু উজ্জীবিত করে তোলে। তখন মস্তিষ্ক নানা রকম আকাশ কুসুম কল্পনা করে যাকে হ্যালুসিনেশান বলা হয়। কিন্তু এর প্রভাব কমে গেলেই আবার মুড সুইং হয়। আর বারবার এর সাহায্য নিলে মুড সুইং পাকাপাকিভাবে আমাদের গ্রাস করে নেবে।

৫| ঘুমের অভাব (Sleep Deprivation)

অতিরিক্ত কাজ, সাংসারিক সমস্যা বা অন্যান্য যে কোনও কারণে যদি দিনের পর দিন আপনার ঘুম না হয় তাহলে স্বাভাবিকভাবেই আপনার মুড সুইং হবে।ঘুম না হওয়ার কারণে আপনি ক্লান্ত থাকবেন এবং আপনার স্নায়ুমণ্ডলী ঝিমিয়ে থাকবে। তখন কোনও কিছুই আপনার ভাল লাগবে না এবং ঘন ঘন মুড পরিবর্তন হবে। 

৬| বাইপোলার ডিসঅর্ডার বা দ্বৈত সত্ত্বা (Bipolar Disorder)

বাইপোলার ডিসঅর্ডার বা দ্বৈত সত্ত্বা যাঁদের থাকে তাঁদেরও অনবরত মুড সুইং হয়। কিন্তু এক্ষেত্রে সমস্যা অন্য জায়গায়। আমরা সাধারণত অবসাদ হলে ডাক্তারের পরামর্শ নিয়ে থাকি। কিন্তু বাইপোলার ডিসঅর্ডার যাঁদের হয়, তাঁদের একটি ম্যানিক স্থিতি বা ফেজ হয়। তখন এঁরা সাঙ্ঘাতিক এনার্জি পান।আচমকা কোনও প্রতিভার বিকাশ হয়। এঁরা তখন ছবি আঁকতে শুরু করেন, বাড়ি রং করতে শুরু করেন এবং এমন অনেক কিছু করেন যা তাঁরা ‘সুস্থ’ অবস্থায় করেন না। কিন্তু এইসময় তাঁরা ডাক্তারের কাছে যান না। কারণ তাঁরা মনে করেন তাঁরা সুস্থ আছেন।এই জাতীয় মানসিক সমস্যা থেকেও কিন্তু মুড সুইং (Mood Swings) হতে পারে।   

৭| ক্যাফেইন ও চিনি (Caffeine & Too Much Sugar)

আমরা মনে করি কফি আমাদের স্নায়ু উজ্জীবিত করে। সারা দিনে একদু’কাপ কফি ঠিক আছে কিন্তু তার চেয়ে বেশি কফি পান করলে মুড সুইং হতে পারে। কারণ কফিতে থাকে ক্যাফেইন। যা সত্যিই স্নায়ু উজ্জীবিত করে কিন্তু তার প্রভাব বেশিক্ষণ থাকে না। ফলে সঙ্গে সঙ্গে আপনার মানসিক স্থিতির পরিবর্তন ঘটে।

৮| প্রিমেনস্ত্রুয়াল অবস্থা বা পিরিয়ডসের আগে (Premenstrual Syndrom)

এটা মেয়েদের হয়,মাসিক শুরুর আগে হরমোনাল চেঞ্জ এর কারনে মুড সুইং দেখা দেয়

৯| মেনোপজ

মাসিক এর আগে যেমন এই সমস্যা দেখা দেয় ঠিক তেমন মেনোপজ শুরু হলে মুড সুইং দেখা দেয়

 

কিভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে পারি মুড সুইং

১. পর্যাপ্ত ঘুম (get proper sleep)

২. কোন রকম উত্তেজক পদার্থ গ্রহন না করা ( Avoid Caffeine and Alcohol)

3. জল পান করা (Drinking too much water)

4. ছোট ছোট ভাগে খাবার খাওয়া (Eat small amount through out the day)  

5. যোগব্যায়াম (Do not skip yoga)  

6. নিজের যত্ন নেওয়া (take care of your self)

7. নিয়মিত এক্সারসাইজ 

এছাড়া আমাদের একটা জিনিষ খেয়াল রাখতে হবে আমাদের রেগুলার ডায়েট এ চেঞ্জ আনতে হবে যেমন প্রসেসড খাবার এরিয়ে চলতে হবে
নিয়মিত ফল আর সবজি রাখতে হবে মেনুতে।

ভালো থাকুন ভালো রাখুন।

লিখেছেন: নবনীতা ঘটক