কর্মজীবনে লোকটি ছিলেন প্রচণ্ড জেদী ও আত্মমর্যাদা সম্পন্ন। ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে মাথা নত করার চেয়ে কাজ থেকে অবসর নেওয়াকে তিনি শ্রেয় মনে করতেন। ইংরেজদের সমস্ত অন্যায়ের বিরুদ্ধে তিনি ছিলেন প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর। অন্যদিকে দেশের দরিদ্র মানুষের জন্য সর্বদা তাঁর হৃদয়ে সহানুভূতি পূর্ণ থাকত। তিনি উনবিংশ শতকের বাঙালি শিক্ষাবিদ, সমাজ সংস্কারক ও গদ্যকার ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর। তাঁর প্রকৃত নাম ঈশ্বরচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়।

ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ১৮২০ খ্রিস্টাব্দের ২৬ সেপ্টেম্বর (বাংলা ১২২৭ বঙ্গাব্দের ১২ আশ্বিন, মঙ্গলবার) বর্তমান পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার বীরসিংহ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ঈশ্বরচন্দ্রের পিতামহ রামজয় তর্কভূষণ ঈশ্বরচন্দ্রের নামকরণ করেছিলেন। ঈশ্বরচন্দ্রের পিতা ঠাকুরদাস বন্দ্যোপাধ্যায় কলকাতায় চাকুরি করতেন। কিন্তু  পরিবার নিয়ে শহরে বাস করা তাঁর সাধ্যের মধ্যে ছিলনা বলে ঈশ্বরচন্দ্রের বাল্যকাল কেটেছে গ্রামে।

আট বছর বয়সে কালীকান্তের পাঠশালায় ভর্তি হন ঈশ্বরচন্দ্র। এই পাঠশালায় তিনি সেকালের প্রচলিত বাংলা শিক্ষা লাভ করেছিলেন। ১৮২৮ সালের নভেম্বর মাসে পাঠশালার শিক্ষা সমাপ্ত করে উচ্চশিক্ষা লাভের জন্য পিতার সঙ্গে কলকাতায় আসেন। কথিত আছে, মেদিনীপুর থেকে কলকাতায় আসার সময় পথের ধারে মাইলফলকে ইংরেজি সংখ্যাগুলি দেখে তিনি আয়ত্ত করেছিলেন।

সংস্কৃত কলেজে সংস্কৃত ও ইংরেজি পড়ার সময় ১৮৩১ সালে তিনি বার্ষিক পরীক্ষায় কৃতিত্বের জন্য মাসিক পাঁচ টাকা হারে বৃত্তি এবং ‘আউট স্টুডেন্ট’ হিসেবে একটি ব্যাকরণ গ্রন্থ ও আট টাকা পারিতোষিক পান। মাত্র ১৪ বছর বয়সে ১৮৩৪ সালে ক্ষীরপাই নিবাসী শত্রুঘ্ন ভট্টাচার্যের কন্যা দীনময়ী দেবীর সঙ্গে তাঁর বিবাহ হয়। দ্বিতীয় বর্ষে সাহিত্য পরীক্ষায় প্রথম স্থান অধিকার করে পনেরো বছর বয়সে প্রবেশ করেন অলংকার শ্রেণীতে। অলংকার শাস্ত্র একটি অত্যন্ত কঠিন বিষয় হলেও তিনি কৃতিত্বের সঙ্গে সাহিত্য দর্পণ, কাব্যপ্রকাশ ও রসগঙ্গাধর প্রভৃতি অলংকারে দক্ষতা অর্জন করেন। ১৮৩৮ সালে তিনি বেদান্ত পাঠও সমাপ্ত করেন।

১৮৩৯ সালের ২২ এপ্রিল হিন্দু ল কমিটির পরীক্ষা দেন ঈশ্বরচন্দ্র। এই পরীক্ষাতেও কৃতিত্বের সঙ্গে উত্তীর্ণ হয়ে ১৬ মে ল কমিটির কাছ থেকে যে প্রশংসাপত্রটি তিনি  পান, তাতেই প্রথম তাঁর নামের সঙ্গে `বিদ্যাসাগর` উপাধিটি ব্যবহৃত হয়। সংস্কৃত কলেজে বারো বছর পাঁচ মাস অধ্যয়নের পর তিনি এই কলেজ থেকে অপর একটি প্রশংসাপত্র লাভ করেন। ১৮৪১ সালের ডিসেম্বর মাসে প্রাপ্ত দেবনাগরী হরফে লিখিত এই সংস্কৃত প্রশংসাপত্রে কলেজের অধ্যাপকগণ ঈশ্বরচন্দ্রকে `বিদ্যাসাগর` নামে অভিহিত করেন।

মাত্র ২১ বছর বয়সে ঈশ্বরচন্দ্র ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের বাংলা বিভাগের পন্ডিত হন। তিনি এই পদে পাঁচ বছর দায়িত্বে ছিলেন। পঁচিশ বছর বয়সে তিনি সংস্কৃত কলেজের সহকারী সম্পাদকের ভার গ্রহণ করেন। ১৮৪৭ সালে স্থাপন করেন সংস্কৃত প্রেস ডিপজিটরি নামে একটি বইয়ের দোকান। এই বছরের এপ্রিল মাসে প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম গ্রন্থ বেতাল পঞ্চবিংশতি।

১৮৫০ সালের আগস্ট মাসে মদনমোহন তর্কালঙ্কারের সহযোগিতায় সর্বশুভকরী পত্রিকা প্রকাশ করেন ঈশ্বরচন্দ্র। ওই বছরই সংস্কৃত কলেজে যোগ দিয়ে তিনি রীতি বদলে ব্রাহ্মণ ও বৈদ্য ছাড়াও কায়স্থদের সংস্কৃত কলেজে অধ্যয়নের সুযোগ করে দেন। আর ডিসেম্বর মাস থেকে সংস্কৃত কলেজের দ্বার সকল বর্ণের মানুষের জন্য উন্মুক্ত করে দেন।

জন্মভূমি বীরসিংহ গ্রামে ঈশ্বরচন্দ্র ১৮৫৩ সালে স্থাপন করেন অবৈতনিক বিদ্যালয়। পরের বছর কালিদাসের অভিজ্ঞান শকুন্তলম অবলম্বনে তাঁর শকুন্তলা প্রকাশিত হয়। তত্ত্ববোধিনী পত্রিকাতে বিধবা বিবাহ প্রচলিত হওয়া উচিত কিনা শীর্ষক একটি প্রবন্ধও প্রকাশিত হয় এই বছরে।

দক্ষিণবঙ্গের চার জেলায় ১৮৫৫ সালে একাধিক মডেল স্কুল বা বঙ্গবিদ্যালয় স্থাপন করেন ঈশ্বরচন্দ্র। এরপরের  বছর তাঁর  ঈশপের কাহিনী অবলম্বনে কথামালা প্রকাশিত হয়। তাঁর চেষ্টায় এই বছরের ১৬ জুলাই বিধবা বিবাহ আইনসম্মত হয়।

১৮৫৭ সালের ২৪ জানুয়ারি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হলে  বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচালনা সমিতির অন্যতম সদস্য মনোনীত হন ঈশ্বরচন্দ্র।  এই বছরের নভেম্বর মাস থেকে ১৮৫৮ সালের মে মাস অবধি সমগ্র দক্ষিণবঙ্গে বিদ্যাসাগর মহাশয় ৩৫টি বালিকা বিদ্যালয় স্থাপন করেন।

তাঁর অবদানে দেশীয় ভাষায় প্রকাশিত সোমপ্রকাশ নামক পত্রিকায় প্রথম  রাজনৈতিক বিষয় স্থান পেয়েছিল। ১৮৬০ সালে তাঁর রচিত বিখ্যাত গ্রন্থ সীতার বনবাস প্রকাশিত হয়। মাত্র চারদিনে তিনি এই গ্রন্থ রচনা করেন। ইংল্যান্ডের রয়্যাল এশিয়াটিক সোসাইটি তাঁকে সম্মানিত সদস্য হিসেবে নির্বাচিত করে যা খুব কম ভারতীয়ই অর্জন করতে পেরেছিলেন।

১৮৭২ সালের ১৫ জুন হিন্দু বিধবাদের সাহায্যার্থে হিন্দু ফ্যামিলি অ্যানুয়িটি ফান্ড নামে একটি জনহিতকর অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান স্থাপন করেন। স্বল্প আয়ের সাধারণ বাঙালির মৃত্যুর পর তাঁর স্ত্রী-পুত্র পরিবারবর্গ যাতে চরম অর্থকষ্টে না পড়েন, তার উদ্দেশ্যেই এই প্রতিষ্ঠানের স্থাপনা। ১৮৮৩ সালে বিদ্যাসাগর পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ের সদস্য নির্বাচিত হন। শেষজীবনে এসে বীরসিংহ গ্রামে মায়ের নামে স্থাপন করেন ভগবতী বিদ্যালয়।

বাংলার নবজাগরণের অন্যতম পুরোধা ব্যক্তিত্ব ও সকল জ্ঞানের আধার ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ১৮৯১ সালের ২৯ জুলাই ৭০ বছর বয়সে প্রয়াত হন। তাঁর মৃত্যুর পর ১৮৯১ সালের সেপ্টেম্বরে তাঁর অসমাপ্ত আত্মজীবনী বিদ্যাসাগর চরিত প্রকাশিত হয়।

ফিচার ডেস্ক | বাংলাদেশদর্পণ.কম