প্রথম পর্বের পর...

১৫৩৩ খ্রিষ্টাব্দের আষাঢ় মাসের শুক্লা সপ্তমীতে পুরীতে শ্রী চৈতন্য মহাপ্রভুর তিরোধান ঘটে। সেই সময়কার প্রত্যক্ষদর্শী ভক্ত ও পান্ডারা বলেন, পুরীর গুন্ডিচা মন্দিরে শ্রীজগন্নাথ দেবের সঙ্গে তিনি লীন হয়ে যান।

কেউ বলেন,পুরীর সমুদ্রে তিনি তিরোধান করেন। আবার কেউ বলেন, মহাপ্রভু আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তা ও মাহাত্ম্যে ঈর্ষান্বিত হয়ে বিরোধী ওড়িয়া পান্ডারা মন্দিরেই তাঁকে হত্যা করে তাঁর দেহ লুকিয়ে ফেলেন। তারও কোনও প্রামাণ্য তথ্য পাওয়া যায় না। তাহলে কোথায় গেলেন তিনি? এ প্রশ্নের উত্তর বিশ্লেষণ করেছিলেন সাপ্তাহিক বর্তমান পত্রিকার বাবু পবিত্র কুমার ঘোষ।

এর পূর্বে প্রথম পর্ব বাংলাদেশদর্পনে প্রকাশ করা হয়েছে। তারই ধারাবাহিকতাই আজ আপনাদের সামনে উপস্থাপন করা হচ্ছে দ্বিতীয় পর্ব।

প্রথম পর্বে আমরা চৈতন্য মহাপ্রভুর অন্তর্ধানের সমকালীন সাক্ষ্য জানিয়েছিলাম। আজ সমকালীনদের জবাবটিই দেব।

লোচনদাস লিখেছেন,মহাপ্রভু মন্দিরে প্রবেশ করা মাত্রই মন্দিরের দরজা বন্ধ হয়ে গেলো। বাইরে দাড়িয়ে আছেন শ্রীবাস,মুকুন্দ দত্ত, গোবিন্দ ঘোষ,রাজগুরু কাশী মিশ্র,নরহরি সরকারসহ প্রমুখ। তাঁরা অপেক্ষা করতে লাগলেন কিন্তু মহাপ্রভু আর বের হলেন না। সবাই উদ্বিগ্ন হয়ে পড়লেন। গুঞ্জাবাড়ির পান্ডাকে দেখতে পেয়ে তাঁরা মন্দিরের দরজা খোলার জন্য ব্যাকুল অনুরোধ জানালেন। পাণ্ডা তাদের বললেনঃ-

                       "গুঞ্জাবাড়ির মধ্যে হৈল প্রভুর অদর্শন

                        সাক্ষাতে দেখিল গৌর-প্রভুর মিলন

                         নিশ্চয় করিয়া যায় শুন সর্বজন"

একজন পাণ্ডা দেখেছেন,শ্রীচৈতন্য জগন্নাথ বিগ্রহে বিলীন হয়ে গেলেন। সে বাইরে এসে অপেক্ষামান জনদের সেকথা বলেছেন। কিন্তু কেউ এ নিয়ে কোন প্রশ্ন করলেন না। তাঁকে সন্দেহই করলেন না। শুধু উঠল হাহাকার।

বার্তা পৌঁছাল রাজা প্রতাপরুদ্রের কাছে। তিনি তখন পুরীতেই ছিলেন। রথযাত্রার সময় তাঁর কর্তব্য থাকে,তিনি সোনার ঝাঁটা দিয়ে রথের আগে আগে ঝাঁট দেন,রথের দড়ি ধরে টানেন। রাজা এই কাজগুলো না করলে রথ চলে না। রাজার এই কাজগুলি আবশ্যকীয় আনুষ্ঠানিক কর্ম। রাজা অবিলম্বে দুঃসংবাদ শুনলেন। তিনি এবং তাঁর পরিবার একান্তভাবে শ্রীচৈতন্যের ভক্ত। গোটা রাজমণ্ডলীই শ্রীচৈতন্যগতপ্রাণ। রাজগুরু কাশী মিশ্র,যিনি নিজের বাড়িটি চৈতন্যের বাসের জন্য ছেড়ে দিয়েছেন,রাজার প্রধান পন্ডিত ও পুরোহিত বাসুদেব সার্বভৌম,বিদ্যানগরের জেলাশাসক রামানন্দ রায়(ইনি চৈতন্যদেবের নিত্য সঙ্গ কামনায় শাসকের পদ ত্যাগ করেছিলেন)সবাই চৈতন্য আশ্রিত একান্ত ভক্ত। এঁরা সবাই পুরীতে,এমনকি গুঞ্জাবাড়িতেও। কিন্তু কেউই শ্রীচৈতন্যের অলৌকিক অন্তর্ধান সম্পর্কে বিন্দুমাত্র সন্দেহ প্রকাশ করলেন না। রাজা এবং তাঁর পরিবার তো খবর পাওয়া মাত্র মুর্ছিত হলেন।

                                    "শ্রীপ্রতাপরুদ্র রাজা শুনিল শ্রবণে

                                    পরিবারসহ রাজা হরিলা চেতনে।"

এ তো গেল লোচনদাসের বিবরণ। তিনি এই বিবরণ অনেকের কাছে শুনেছিলেন,ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী গুরু নরহরি সরকারের কাছে তো বটেই। তিনি "শ্রীচৈতন্যমঙ্গল" গ্রন্থ লিখেছিলেন গুরু নরহরির আদেশে। তবু তিনি বাংলার মানুষ,শ্রীচৈতন্যের অন্তর্ধানের সময় তাঁর বয়সও বেশি হয়নি।

কিন্তু ওড়িয়া ভক্ত অচ্যুতানন্দ পুরীতে শ্রীচৈতন্যের ঘনিষ্ঠ সান্নিধ্যে এসেছেন,অন্তর্ধানের সময় ঘটনাস্থলে তিনিও উপস্থিত ছিলেন। তিনি ওড়িয়া ভাষায় "শূন্যসংহিতা" নামে বই লিখেছেন। ওই বইয়ের বর্ণনাঃ-

                                 "এমন্তে কেত্তেহে দিন বহি গেলা শুনিমা অপূর্বরস।

                                 প্রতামরুদ্র রাজন দ্বিজে কলে কালরাত্রটার পার্শ্ব।

                               এমন্ত সময়ে গৌরাঙ্গচন্দ্রমা বেড়া প্রদিক্ষণ করি।

                             দেউলে পশিলে সখাগণ সঙ্গে দণ্ড কমণ্ডুল ধরি।

                         মহাপ্রতাপরুদ্রদেব রাজা ঘেণিল পাত্র মন্ত্রী মান সঙ্গে।

                              হরিধ্বনিয়ে দেউল উছলই শ্রীমুখদর্শন রঙ্গে।

                            চৈতন্যঠাকুর মহানৃত্যকার রাধা রাধা ধ্বনি কলে।

                          জগন্নাথ মহাপ্রভু শ্রীঅঙ্গরে বিদ্যুৎপ্রায় মিশি গলে।"

অর্থাৎ গৌরচন্দ্রমা সখাগণের সঙ্গে মন্দির প্রদক্ষিণ করে মন্দিরে প্রবেশ করলেন। তিনি মহানৃত্য করতে করতে রাধা-রাধা ধ্বনি করে বিদ্যুতের মতো জগন্নাথ অঙ্গে মিশে গেলেন।

এই বর্ণনা থেকে দেখছি শ্রীচৈতন্য সেদিন একা ছিলেন না। তাঁর সঙ্গে তাঁর সখারা,ভক্তরা ছিলেন। আরও ছিলেন পাত্র মিত্র মন্ত্রীদের সঙ্গে স্বয়ং রাজা প্রতাপরুদ্র। শ্রীচৈতন্য অসুস্থ ছিলেন না। তিনি মহানৃত্য করছিলেন,মুখে রাধা-রাধা ধ্বনি করছিলেন। তিনি সবার সামনে বিদ্যুতের মতো জগন্নাথ বিগ্রহের সঙ্গে মিশে গেলেন।

সেসময় যে মন্দিরের কপাট বন্ধ ছিল সেকথা অচ্যুতানন্দ লেখেননি। পাণ্ডা এসে শ্রীচৈতন্যের অদৃশ্য হওয়ার সংবাদ দিলেন একথাও অচ্যুতানন্দ লেখেননি।

তাহলে এখানে আমরা দেখতে পারি সেদিন ঘটনাস্থলে উপস্থিত থাকা দুজন ব্যক্তির দুরকম মতবাদ। একজন শ্রীখন্ডের নরহরি সরকার যনি তার শিষ্য লোচনদাসকে ঘটনার বিবরণ শুনিয়েছেন একরকম অন্যজন উপস্থিত থাকা শান্তিপুরের অচ্যুতানন্দ যিনি ঘটনার বিবরণ দিয়েছেন অন্যরকম। কিন্তু অচ্যুতানন্দ কতটা বিশ্বাসযোগ্য?

বিস্তারিত জানতে চোখ রাখুন আগামী পর্বে...

প্রথম পর্ব: চৈতন্য মহাপ্রভু জগন্নাথ মন্দির থেকে অন্তর্ধান হয়েছিলেন কীভাবে?