১৫৩৩ খ্রিষ্টাব্দের আষাঢ় মাসের শুক্লা সপ্তমীতে পুরীতে শ্রী চৈতন্য মহাপ্রভুর তিরোধান ঘটে। সেই সময়কার প্রত্যক্ষদর্শী ভক্ত ও পান্ডারা বলেন,পুরীর গুন্ডিচা মন্দিরে শ্রীজগন্নাথ দেবের সঙ্গে তিনি লীন হয়ে যান।

কেউ বলেন,পুরীর সমুদ্রে তিনি তিরোধান করেন। আবার কেউ বলেন, মহাপ্রভু আকাশচুম্বী জনপ্রিয়তা ও মাহাত্ম্যে ঈর্ষান্বিত হয়ে বিরোধী ওড়িয়া পান্ডারা মন্দিরেই তাঁকে হত্যা করে তাঁর দেহ লুকিয়ে ফেলেন। তারও কোনও প্রামাণ্য তথ্য পাওয়া যায় না। তাহলে কোথায় গেলেন তিনি? এ প্রশ্নের উত্তর বিশ্লেষণ করেছিলেন সাপ্তাহিক বর্তমান পত্রিকার বাবু পবিত্র কুমার ঘোষ।

আজ থেকে পর্ব আকারে বাংলাদেশদর্পনে প্রতিবেদনটি প্রকাশ করা হবে। তারই ধারাবাহিকতাই আজ আপনাদের সামনে উপস্থাপন করা হচ্ছে প্রথম পর্ব।

শ্রীচৈতন্য মহাপ্রভুর জীবন ছিল বহুজনগোচর,কিন্তু মৃত্যু? তাঁর জীবনের তথ্য ও সত্য নিয়ে সংশয় দেখা দেয়নি। কিন্তু তাঁর মৃত্যু রয়েছে রহস্যে ঘেরা। সে রহস্য উন্মোচন হয়নি কোনওদিন। বিশ্বাসীরা দেখেছেন বিশ্বাসের দৃষ্টিতে আর অবিশ্বাসীরা প্রকাশ করেছেন সংশয়। কিন্তু তথ্যই বা কী, সত্যই বা কী? ভারতের সমগ্র ইতিহাসে আমজনতার নয়নমণি বলে যদি কেউ থাকেন তবে তিনি চৈতন্য মহাপ্রভু। লক্ষ লক্ষ মানুষ তাকে শ্রদ্ধা করত। হাজার হাজার মানুষ তাঁর পিছনে ছুটত। প্রথম যৌবনেই তিনি ভাববন্যা এনেছিলেন বাংলায়। যৌবনের দ্বিতীয় পর্বে তিনি উদ্বেল করেছিলেন ওড়িশাকে। জীবদ্দশাতেই তাঁর প্রভাব ছড়িয়ে পড়েছিল আসাম থেকে গুজরাট পর্যন্ত এবং দাক্ষিণাত্যেও।

সমসাময়িকরা সাক্ষ্য দিয়েছেন, শ্রীচৈতন্যের জীবনান্তও হয়েছিলো বহু মানুষের সামনে। সমসাময়িকদের সেই সাক্ষ্যই আগে উদ্ধৃত করছি।

শ্রীচৈতন্যের অন্তরঙ্গ পার্ষদ নরহরি সরকারের শিষ্য লোচন দাস তাঁর 'শ্রীচৈতন্যমঙ্গল' কাব্যগ্রন্থে লিখেছেন, "আষাঢ় মাসের সপ্তমী তিথিতে,রবিবারে,বেলা তৃতীয় প্রহরে-অর্থাৎ পরিষ্কার দিনের আলোয় মহাপ্রভু গুঞ্জাবাড়ির জগন্নাথ মন্দিরে(গুন্ডিচা মন্দির) প্রবেশ করে জগন্নাথ বিগ্রহকে দৃঢ়ভাবে আলিঙ্গন করলেন। সঙ্গে সঙ্গে তিনি অদৃশ্য হলেন। সেই তাঁর শেষ।"

"তৃতীয় প্রহর বেলা রবিবার দিনে।

 জগন্নাথে লীন প্রভু হইলা আপনে।"

পুরীর প্রধান জগন্নাথ মন্দির থেকে গুন্ডিচা মন্দির আলাদা। রথযাত্রার সময় জগন্নাথ বিগ্রহকে মূল জগন্নাথ মন্দির থেকে এনে কয়েকদিনের জন্য গুন্ডিচা মন্দিরে রাখা হয়।

সে বছর রথযাত্রা হয়েছিলো আষাঢ় মাসের শুক্লা দ্বিতীয়ায়। সপ্তমী তিথিতে জগন্নাথদেব গুন্ডিচা মন্দিরেই ছিলেন। রথযাত্রা উপলক্ষে হাজার হাজার লোক সেসময়ও পুরীতে যেতেন। উল্টোরথের দিন জগন্নাথ,বলরাম,সুভদ্রা আবার তাঁদের স্থায়ী আবাসন মূল জগন্নাথ মন্দিরে ফিরে না যাওয়া পর্যন্ত দূর দূরান্ত থেকে আসা ভক্তরা পুরীতেই থেকে যেতেন। রথযাত্রা এবং ফিরতি রথযাত্রা সমাপ্ত না হওয়া পর্যন্ত পুরী থাকত লোকে লোকারন্য।

চৈতন্যদেব যতদিন পুরীতে ছিলেন ততদিন প্রতি রথযাত্রাতেই তিনি যোগ দিতেন। তাঁর আকর্ষণও কম ছিল না। জগন্নাথদেবকে দেখতে যাওয়া আর চৈতন্যদেবকে দেখতে যাওয়া,কোন আকর্ষণ যে বেশি ছিল তা বলা যায় না। বিশেষত প্রতি বছর বাংলা থেকে যাঁরা রথযাত্রার সময় পুরী যেতেন তাঁদের কাছে শ্রীচৈতন্যের আকর্ষণই ছিল বেশি।

শ্রীচৈতন্যদেব মোট চব্বিশ বছর ধরে পুরীর বাসিন্দা হলেও এই দীর্ঘকালের সবটা সময় তিনি পুরীতে থাকেননি। তাঁর দাক্ষিণাত্য ভ্রমণে কেটেছিল দুই বছর। একবার তিনি বাংলায় এসেছিলেন। আর একবার গিয়েছিলেন কাশী ও বৃন্দাবন। এভাবে মোট চার বছর তিনি পুরীর বাইরে থাকায় রথযাত্রায় যোগ দিতে পারেননি।

বাকি বিশ বছরে প্রতি রথযাত্রায় তিনি শুধু একাই অংশ নেননি,তাঁর অন্যান্য ভক্তও তাঁর সঙ্গে থাকতেন। বাংলা থেকে ভক্তরা ওই বিশ বছরে প্রতি রথযাত্রার সময় পুরী যেতেন। ১৫৩৩ খ্রিষ্টাব্দের রথযাত্রার সপ্তাহে তিনি যখন অপ্রকট হলেন সে সময়ও বাঙালী ভক্তদের বিরাট দলটি পুরীতে উপস্থিত ছিলেন।

তাঁরা শুধু উপস্থিতই থাকতেন না। তাঁরা পদে পদে মহাপ্রভুকে অনুসরণ করতেন। মহাপ্রভু যখন কাশীশ্বর মিশ্রের বাড়ির গম্ভীরা কক্ষের নিভৃত বাস থেকে বের হতেন তখন হাজার হাজার মানুষ তাঁর পিছনে যেত। যে বছর গুলিতে তিনি গম্ভীরা কক্ষে একান্ত আত্মমগ্ন হয়ে বাস করেছিলেন,অল্প কয়েকজনই সে সময় তাঁর নাগাল পেয়েছিলেন। কিন্তু রথযাত্রার দিনগুলোতে তিনি নিভৃত বাস থেকে বেরিয়ে এসে সর্বজনের সামনে দাঁড়াতেন,রথের আগে আগে নাচতে নাচতে যেতেন,কীর্তন করতেন।

বাংলা থেকে যাঁরা যেতেন তারা সাতটি সম্প্রদায়ে ভাগ হয়ে মহাপ্রভুর সঙ্গে কীর্তন করতেন। এই সাত সম্প্রদায়ের নেতৃত্ব দিতেন যথাক্রমে স্বরুপ দামোদর, শ্রীবাস,মুকুন্দ দত্ত,গোবিন্দ ঘোষ,কুলীনগ্রামের রামানন্দ এবং সত্যরাজ,শ্রীখন্ডের নরহরি সরকার(লোচনদাসের গুরু), শান্তিপুরের অচ্যুতানন্দ(শ্রীঅদ্বৈত আচার্যের পুত্র)

১৫৩৩ খ্রিষ্টাব্দের রথযাত্রার সময় এঁরা সবাই পুরিতে ছিলেন,রথের সঙ্গে সঙ্গে কীর্তন ও নৃত্য করেছিলেন, আকুল নয়নে মহাপ্রভুকে দেখেছেন। তাঁরা মহাপ্রভুর কাছছাড়া হতেন না। মহাপ্রভুও তাদেরকে কাছছাড়া করতেন না। সাত সম্প্রদায়ের মধ্যে চার সম্প্রদায় যেত রথের আগে,দুই সম্প্রদায় রথের পাশে আর এক সম্প্রদায় রথের পিছনে। মহাপ্রভু এই সাত সম্প্রদায়ের সঙ্গেই ঘুরতেন,নাচতেন,হরি হরি বলতেন-

"সাত ঠাঞি বুলে প্রভু হরি হরি বলি।

জয় জয় জগন্নাথ করে হস্তে তুলি।"

১৫৩৩ খ্রিষ্টাব্দের আষাঢ়ী শুক্লা সপ্তমী তিথিতে দিনের বেলা মহাপ্রভু যখন গুন্ডিচা মন্দিরে প্রবেশ করলেন তখন ওই সাত সম্প্রদায়ের প্রায় ৪৫০ জন (প্রতি সম্প্রদায়ে চোদ্দো মাদল বাজাত চোদ্দো জন,কীর্তন গাইত বিয়াল্লিশ জন,নাচত সাত জন) তো ছিলেনই,এ ছাড়াও আরও শত শত মানুষ সেখানে ছিলেন। তাঁদের সামনে দিয়েই চৈতন্য মহাপ্রভু গুন্ডিচা মন্দিরে প্রবেশ করলেন। এই হল সমকালীন সাক্ষ্য। কিন্তু তারপর কি হল?

বিস্তারিত জানতে চোখ রাখুন আগামী পর্বে........