যশোর: যশোরের বাঘারপাড়া উপজেলার খানপুর গ্রামে অবস্থিত পাঁচ শতাব্দী প্রাচীন ঐতিহ্যবাহী শিব মন্দিরটি অযত্ন আর অবহেলায় নিশ্চিহ্ন হতে বসেছে।

মন্দিরটি যশোর শহর থেকে ৩০ কি.মি. উত্তর-পূর্বে এবং যশোর-মাগুরা হাইওয়ে থেকে ৩ কি.মি. পূর্বে নারিকেলবাড়ীয়া ইউনিয়নে অবস্থিত। যশোর জেলার শেষ প্রান্তে খানপুর বাজারের পশ্চিম পাশে চিত্রা নদীর পাড়ে অবস্থিত মন্দিরটি বহন করছে শতশত বছরের ইতিহাস। 

বহু প্রাচীন এই মন্দিরটি প্রতিষ্ঠার প্রকৃত ইতিহাস জানা যায় না। জনশ্রুতি আছে, খাজুরার জমিদার বোস বাবুদের আমলে এই শিব মন্দিরে পূজা-অর্চনা, রক্ষণাবেক্ষণ, ভক্তসেবা ও বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদি পরিচালনার জন্য ফরিদপুরের কোটালিপাড়া (বর্তমান গোপালগঞ্জ) থেকে একজন পূজারীকে এনে মন্দিরের দায়িত্ব বুঝিয়ে দেন জমিদার বোস বাবুরা।

ঐসময় এই শিব মন্দিরের আওতায় প্রায় ৮ একর জমি ছিল। কালক্রমে ঐ পূজারীর মৃত্যুর পর তার ছেলে হেমন্ত ভট্টাচার্য পুরোহিত হিসাবে দায়িত্ব পালন করতেন। এখানে সারা বছর বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠানাদি, চৈত্র সংক্রান্তিতে শিবপূজা ও জমজমাট গ্রামীণমেলা এবং গানের আসর বসতো।

প্রায় ৭৫ বছর পূর্বে হেমন্ত ভট্টাচার্যের মৃত্যু হলে তার চার ছেলে বাবুলাল ভট্টাচার্য, হরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য, বদ্রীনাথ ভট্টাচার্য ও আদ্যনাথ ভট্টাচার্য মন্দিরের দায়িত্ব নেন। ১৯৪৭-এর দেশ ভাগের পূর্বে ব্রিটিশ আমলে বড় ছেলে বাবুলাল ভট্টাচার্য নড়াইলের জমিদারের কাছারীর দায়িত্বে থাকাকালীন ভারতে চলে যান। দেশ ভাগের পর পাকিস্তান আমলে পর্যায়ক্রমে সেজ ছেলে বদ্রীনাথ ভট্টাচার্য ও ছোট ছেলে আদ্যনাথ ভট্টাচার্য তাদের পরিবারের সকল সদস্যকে নিয়ে কলকাতায় পাড়ি জমান। তাদের দেশান্তরের কিছুদিনের মধ্যে মন্দিরের প্রাচীন কষ্টি পাথরের আসল শিবলিঙ্গটি চুরি হয়ে যায়। পরবর্তীতে একটি পাথরের শিবলিঙ্গ বসানো হয়।

হেমন্ত ভট্টাচার্যের চার ছেলের মধ্যে এদেশেই থেকে যান মেজ ছেলে হরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য। তিনি দেশেই মৃত্যুবরণ করেছেন। হরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্যের দুই ছেলে। বড় ছেলে দুলাল ভট্টাচার্য আর ছোট ছেলে গোপাল ভট্টাচার্য। বড় ছেলে দুলাল ভট্টাচার্য দেশান্তরিত হয়ে ভারতে গেলেও ছোট ছেলে গোপাল ভট্টাচার্য বাংলাদেশে বড় পদে চাকরি করেন এবং মাগুরাতে স্থায়ীভাবে বসবাস করেন।

খানপুর গ্রামের মৃত সীতানাথ পালের ছেলে নরেন্দ্রনাথ পাল (৮৫) বলেন, ‘বিভিন্ন জরিপের সময়ে ঐসব জমি পূজারীরা নিজ নামে রেকর্ড করে নিয়ে ধীরে ধীরে বিক্রি করে ফেলেছে। কিছু জায়গাজমি হরেন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য তথা তার ছেলে গোপাল ভট্টাচার্যের আছে বলে জানি। তবে শিব মন্দিরের আওতায় ৬ শতাংশ জমি আছে বলেও শুনেছি।’

তিনি আরও বলেন, মন্দিরটি জরাজীর্ণ অবস্থায় আছে। মন্দিরটি সংস্কার করতে পারলে আশপাশের প্রায় ৪০-৫০টি পরিবারের প্রার্থনা করার জন্য একটা জায়গা তৈরী হবে। প্রাচীন এ স্থাপত্যটিও ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা পাবে।

এলাকাবাসীর ধারণা, সম্রাট শেরশাহের আমলে অথবা তারও পূর্বে রাজা-বাদশাহের আমলে এই শিব মন্দিরটি নির্মাণ করা হয়েছিল। তবে আকৃতিগত এবং টেরাকোটার কারুকার্যের দিক দিয়ে এটি বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের সংরক্ষিত স্থাপনায় থাকা যশোরের চাঁচড়া শিব মন্দিরের মতো। মন্দিরটি ‘আট-চালা’ ধরণের স্থাপনা। ‘আট-চালা’ রীতি বাংলার মন্দির স্থাপত্যকলার বিশেষ এক ধরণের রীতি। যেখানে বর্গাকার বা আয়তাকার গর্ভগৃহের ‘চৌ-চালা’ ছাদের উপরে আরেকটি ছোট ‘চৌ-চালা’ ছাদ তৈরি করা হয় (বর্তমানে চৌ-চালা ছাদটি ভেঙে পড়েছে)। 

প্রাচীন আমল থেকে এই শিব মন্দিরে পূজা অর্চনা হয়ে আসলেও বর্তমানে সেটি প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। ভগ্ন মন্দিরের ভেতর এখন চামচিকা বসতি গড়েছে। সেই সাথে মন্দিরের উপর জন্ম নিয়েছে বিভিন্ন ধরণের আগাছা। আঙ্গিনাটি ময়লা ফেলার ভাগাড় এবং প্রসাবখানায় পরিণত হয়েছে। 

এত কিছুর পরও আজও পুরো মন্দিরের দেয়ালে জ্বলজ্বল করছে টেরাকোটার বিভিন্ন কারুকার্য। কিন্তু আবাক হওয়ার বিষয়, এত পুরাতন মন্দির হওয়া সত্ত্বেও জেলা বা উপজেলার ওয়েবসাইটে এর কোন নাম পর্যন্ত নেই। সত্যিকার অর্থেই এই ঐতিহ্যবাহী প্রাচীন মন্দিরটি অবহেলিত।

অন্যদিকে খানপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের প্রাক্তন প্রধান শিক্ষক চিত্তরঞ্জন ভদ্র বলেন, ‘মন্দিরটি বাঘারপাড়া উপজেলার সবচেয়ে পুরাতন মন্দির। আমাদের ছেলেবেলায় দেখেছি মন্দিরে পূজা-অর্চনা হতো। বিশেষ করে চৈত্রসংক্রান্তিতে এখানে ধুমধাম করে শিব পূজা এবং গ্রামীণমেলা বসতো। পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন গ্রাম হতে ভক্তরা আসতেন। 

পোড়ামাটির টেরাকোটা দ্বারা সজ্জিত ধ্বংসপ্রায় মন্দিরটি এই জনপদের সমৃদ্ধ ঐতিহ্যের প্রমাণ বহন করে। প্রাচীন এই মন্দিরটি রক্ষার জন্য তিনি সরকারের আশু পদক্ষেপ কামনা করেন।

তিনি আরও বলেন, ‘অনন্য স্থাপত্য নিদর্শন এই মন্দিরটি শুধু খানপুর গ্রামের অমূল্য সম্পদ নয় এটা যশোরের অন্যতম পুরাতন স্থাপনা।’ মন্দিরটি সংস্কারের জন্য মহৎপ্রাণ মানুষদের এগিয়ে আসার আহ্বান জানান তিনি।

সন্দীপ মন্ডল, নিজস্ব প্রতিবেদক | বাংলাদেশদর্পণ.কম