কিশোরগঞ্জ শহরের বর্তমান আখড়াবাজার এলাকায় অবস্থিত প্রাচীন শ্রী শ্রী শ্যামসুন্দর লক্ষী নারায়ণ জিউর আখড়াটি এখন কালের সাক্ষী। কিশোরগঞ্জ শিল্পকলা একাডেমী সংলগ্ন হিন্দু সম্প্রদায়ের অতীত ও বর্তমানকালের বিখ্যাত ধর্মীয় পীঠস্থানটি শহরের অন্যতম সেরা আকর্ষণ। এলাকাবাসীর নিকট মন্দিরটি 'শ্যামসুন্দর আখড়া' নামেই বহুল পরিচিত।

এই আখড়ার দোলমঞ্চ ও অন্যান্য নিদর্শন আজো যে কোনো পথিকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। এই আখড়াকে কেন্দ্র করেই এলাকাটি ‘আখড়া বাজার’ নামে পরিচিত লাভ করেছে বর্তমানে।

আখড়া ও মন্দিরটির স্থাপনকাল সম্পর্কে সঠিক সময় নির্ণয়ের কোন রেকর্ডপত্র উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। তবে এটুকু জানা গেছে যে, ১৮৭৬ খ্রিস্টাব্দে ব্রহ্মজ্ঞানী মহাত্মা বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামী কিশোরগঞ্জে এসে দু’টি ব্রাহ্মধর্ম সভায় যোগদান ও বক্তৃতা দেন।

বক্তৃতা দেয়ার পর স্থানীয় হিন্দু সম্প্রদায়, বিশেষ করে ব্রাহ্মণ ও গোড়া ধর্মপ্রাণ হিন্দুগণ বিজয়কৃষ্ণ গোস্বামীর মতামতের বিরুদ্ধে উক্ত আখড়ায় ‘ধর্মসভা’ নামে এক সভার আয়োজন করেছিলেন। সে সময়ে এ আখড়ায় একটি সংস্কৃত শিক্ষার টোলও প্রতিষ্ঠিত ছিল। গৌরচন্দ্র পাঠক নামে একজন খ্যাতনামা পন্ডিত উক্ত টোলের শিক্ষকতায় নিয়োজিত ছিলেন। এ থেকে প্রমাণিত হয় যে, ১৮৭৬ খ্রিস্টাব্দের পূর্বেই আখড়াটি প্রতিষ্ঠিত ছিল।

পার্শ্ববর্তী এলাকা হয়বতনগরের দেওয়ানদের নিয়ে এই আখড়া সম্পর্কিত সুন্দর একটি তথ্য রয়েছে। জানা যায়, বর্তমান আখড়া বাজারসহ আশে পাশের বিস্তীর্ণ এলাকা ছিল জঙ্গল। রাখাল বালকের জঙ্গলের আশে পাশের পতিত জমিতে গরু চরাত। একদিন রাখাল ছেলেরা জঙ্গলের মধ্য থেকে ধোয়া উঠতে দেখে কৌতুহলবশে তারা বনের মধ্যে প্রবেশ করে জ্বলন্ত আগুনের পাশে একজন সন্নাসীর বসে থাকতে দেখে। পরে পর্যায়ক্রমে সন্নাসীর কথা চারিদিকে ছড়িয়ে পড়ে।

ঐ এলাকাটি ছিল হয়বতনগরের দেওয়ানদের। দেওয়ান সাহেব হুকুম দিলেন সাধুকে ধরে নিয়ে আসতে। কিন্তু সাধুকে কোন অবস্থাতেই, এমনকি তার পাইক বরকন্দাজগণ শক্তি প্রয়োগ করেও স্থানচ্যুত করতে পারলো না। সাধু সর্ম্পকে নানা কথা এতদিনে ছড়িয়ে পড়েছে। দেওয়ান সাহেব শেষ পর্যন্ত নিজে এসে সাধুর সাথে দেখা করেন। দেওয়ান সাহেব সাধুর প্রতি অনুরাগ বশতঃ বর্তমান আখড়া বাজারস্থ বিরাট এলাকাটি মন্দির ও আখড়া স্থাপনের জন্য দানপত্র করে দেন। এভাবেই প্রতিষ্ঠিত হল শ্যামসুন্দর লক্ষ্মী নারায়ণ জিউড় আখড়া।

হয়বতনগর জমিদার কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত বলে অতীতে আখড়াটিতে প্রথম মেহান্ত থেকে পরবর্তীকালে নতুন মোহান্ত নির্ধারিত হলে তাকে প্রথমেই দেওয়ানবাড়ির উত্তরাধিকারীর বা হাতের কড়ে আঙ্গুলে কপালে দেয়া সিদুরের টিকা নিয়ে পদে অভিষিক্ত হতে হতো। শেষ মোহান্ত পর্যন্ত এই নিয়ম বলবৎ ছিল।

যারা মোহান্ত ছিলেন তাদের মধ্যে রয়েছেন (ক্রমানুসারে) শ্রী শ্রী ব্রজবল্লব গোস্বামী, শ্রী কৃষ্ণমঙ্গল গোস্বামী, গঙ্গা গোবিন্দ অধিকারী, রাধাগোবিন্দ অধিকারী (১), রাধাগোবিন্দ অধিকারী (২), ব্রজগোপাল অধিকারী, দোল গোবিন্দ অধিকারী, দয়াল গোবিন্দ অধিকারী, গোকুল গোবিন্দ অধিকারী, প্রহলাদ চন্দ্র অধিকারী, নগেন্দ্র গোবিন্দ গোস্বামী, রামানন্দ দাস বাবাজী, সদানন্দ দাস বাবাজী। শেষ দুই মোহান্ত জমিদারী স্বত্ব উচ্ছেদের পর অধিষ্ঠিত হয়েছিলেন। শ্রী গোকুল গোবিন্দ অধিকারীর সময় আখড়া সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য সেবাইতের পাশাপাশি একটি পরিচালনা কমিটি গঠন করা হয়।

বাংলা ১৩৯১ সনের ১০ই পৌষ সর্বশেষ মোহন্ত শ্রী সদানন্দ দাস বাবাজী লোকান্তরিত হবার পর আর কোন সেবাইত নিয়োগ করা হয়নি। স্বাধীনতার পর যে সকল ব্যক্তিবর্গ কমিটির প্রধানের দায়িত্ব পালন করেছেন তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য প্রখ্যাত আইনজীবী পরলোকগত শ্রী হেমেন্দ্র নারায়ন রায়। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় এই প্রাচীন আখড়াটি বেশ ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছিল।

বর্তমানে শ্যামসুন্দর আখড়াটি প্রাচীনতম নিদর্শন হিসাবে দাঁড়িয়ে আছে। মাঝখানে অবহেলিত থাকলেও বর্তমানে সকলের সহযোগিতায় আখড়াটির অনেক উন্নয়ন সাধিত হচ্ছে এবং সংস্কার কাজ অব্যহত আছে।

সম্প্রতি আখড়ার মূল মন্দিরটিতে রাধা-শ্যামসুন্দরের পাথরের বড় বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। যা মন্দিরের শোভা অনেকগুণ বাড়িয়েছে এবং বর্তমানে একটি দৃষ্টিনন্দন শিব মন্দির নির্মাণের কাজ চলছে।

বর্তমানে সম্পূর্ণ আখড়াটিতে রাধা-শ্যামসুন্দরের একটি মূল মন্দির, দূর্গা মন্দির, নাট মন্দির, দোলমন্দির, রন্ধনশালা ও একটি ছাত্রাবাস রয়েছে। এছাড়া মন্দিরের ফটকের সামনে মন্দিরের বিশাল একটি পুকুরও রয়েছে।

মাঝখানে কিছুটা স্থবিরতা থাকলেও এখন অত্যন্ত আড়ম্বড়পূর্ণভাবেই বিভিন্ন পূজা-পার্বন, লীলাকীর্তন ও রামায়নের পালার আয়োজন করা হয়। এছাড়া রাসপূর্ণিমা উৎসবে আখড়াটিতে ৫ দিনব্যাপী বাৎসরিক নাম সংকীর্তন অনুষ্ঠিত হয়। বর্তমানে দোল উৎসবে মন্দিরে প্রতিষ্ঠিত পুনঃসংস্কার করা ঐতিহাসিক দোল মন্দিরটিতে অত্যন্ত আড়ম্বরপূর্ণভাবে দোলযাত্রা অনুষ্ঠিত হয়।

আখড়ার আশেপাশের সম্পত্তি ও ছাত্রাবাসের আয়ের উৎস দিয়েই মন্দির পরিচালনা করা হয়। মন্দিরের সেবায় একজন কেয়ারটেকার, একজন সেবায়েত, একজন মহিলা সেবায়েত ও একজন ক্লিনার রয়েছে তারা বেতন ভুক্ত। কর্তৃপক্ষের মতে মন্দিরের যে স্বল্প আয় হয়, তা দিয়ে মন্দিরের খরচ ভালোভাবে চলে না।

এলাকাবাসীরা জানান, মন্দিরটি এলাকার গৌরব ও প্রাচীন নিদর্শন। এর সৌন্দর্য রক্ষা করা সকলের নৈতিক দায়িত্ব। তাই সমাজের বিত্তশালীরা যেন মন্দিরটির উন্নয়নে এগিয়ে আসেন যেন সুদূর ভবিষ্যতেও এই ঐতিহাসিক মন্দিরটি কালের স্বাক্ষী হয়ে থাকে। আগামী প্রজন্ম এর ইতিহাস জানতে পারে।

উল্লেখ্য, ঐতিহাসিক এই মন্দিরটির অনেক জায়গা অসাধু কিছু ভূমিদস্যুদের দ্বারা বেদখল হয়ে আছে যা উদ্ধার করে ঐতিহাসিক এ নিদর্শনটি ধরে রাখা প্রয়োজন।

অর্জুন কর্মকার | কিশোরগঞ্জ