নীহাররঞ্জন রায় (১৪ জানুয়ারি ১৯০৩ - ৩০ আগস্ট ১৯৮১) উপমহাদেশের শেষ বহুশাস্ত্রজ্ঞদের মধ্যে অন্যতম। জ্ঞানের বিভিন্ন ক্ষেত্র যেমন- শিল্পকলা, প্রাচীন ও আধুনিক সাহিত্য, ইতিহাস, ধর্ম, রাজনীতি এবং জীবন কাহিনিসহ নানা বিষয়ে তিনি কাজ করেন এবং গ্রন্থ রচনা করেন।

নীহাররঞ্জন রায় প্রথম খ্যাতি অর্জন করেন শিল্প-ইতিহাস চর্চায় এবং এ বিষয়টিই ইতিহাসের সমন্বিত দৃষ্টিভঙ্গির ক্ষেত্রে তার গবেষণার ভিত্তি হয়ে উঠেছিল। মানব অভিজ্ঞতার রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক দিকগুলোর মধ্যে সমন্বয় সাধনে নীহাররঞ্জন রায়ের প্রচেষ্টা পরিণতি লাভ করেছে তার প্রধান সাহিত্যকর্ম 'বাঙ্গালীর ইতিহাস' গ্রন্থে। এই ধ্রুপদি সৃষ্টি রাজনৈতিক পরিভাষায় ইতিহাস বিশ্নেষণ থেকে শুরু করে একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক পরিবর্তনের সূচনা ঘটায় এবং তা এই প্রথম বাংলার সাধারণ মানুষকে ইতিহাসবিদদের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু করে তোলে। গ্রন্থটির সাহিত্যমূল্যের ক্ষেত্রে এ বিষয়টিও কম গুরুত্বপূর্ণ নয়।

কর্মজীবনে তিনি বিবিধ পেশার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে কিছুদিন গ্রন্থাগারিকের পদে কাজ করার পর তিনি চারুকলা বিভাগের বাগেশ্বরী অধ্যাপক এবং প্রাচীন ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের অধ্যাপক ছিলেন। তিনি রাজ্যসভা ও ভারতীয় পে-কমিশনের সদস্যও ছিলেন।

সিমলার ইনস্টিটিউট অব অ্যাডভান্সড স্টাডিজের প্রতিষ্ঠাতা পরিচালক হিসেবে কাজ করেছেন। কলকাতার জাতীয় গ্রন্থাগার ও ভারতীয় জাদুঘরের মতো সংস্থাগুলোর প্রশাসনেও তিনি কাজ করেছেন। তিনি দেশি-বিদেশি বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের অতিথি অধ্যাপক, Royal Asiatic Society, International Association of Arts and Letters (জুরিখ) এবং কলকাতার এশিয়াটিক সোসাইটির ফেলো ছিলেন। তিনি 'সাহিত্য আকাদেমি পুরস্কার' ও ভারত সরকারের 'পদ্মভূষণ'-এর মতো সম্মানজনক উপাধি লাভ করেন।

বর্তমান বাংলাদেশের ময়মনসিংহে জন্মগ্রহণ করেন নীহাররঞ্জন রায়। তিনি প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেন স্থানীয় ন্যাশনাল স্কুলে, যেখানে তার পিতা মহেন্দ্রচন্দ্র রায় শিক্ষকতা করতেন। সিলেটের মুরারীচাঁদ কলেজ থেকে ইতিহাসে অনার্সসহ স্নাতক (১৯২৪) এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারতের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ থেকে ১৯২৬ সালে এমএ পাস করেন। ওই বছরই তিনি তার Political History of Northern India, AD 600-900 নিবন্ধের জন্য 'মৃণালিনী স্বর্ণপদক' পান।

১৯২৭ থেকে ১৯৩৩ সালে কিছুকাল তিনি তার শিক্ষক অধ্যাপক বেণীমাধব বড়ূয়ার সঙ্গে বার্মায় কাটান এবং একত্রে বার্মিজ মন্দির স্থাপত্যের ওপর ব্যাপক গবেষণা চালান। এ গবেষণার ফলে কারুশিল্পের প্রতি তার আকর্ষণ গভীর হয় এবং তিনি উপলব্ধি করেন যে, সমাজ, রাষ্ট্র ও সংস্কৃতির বৃহত্তর পরিমণ্ডল থেকে বিচ্ছিন্নভাবে শিল্পকলা সম্পর্কে অধ্যয়ন করা যায় না। বার্মাতেই তার মনে বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর অবিচ্ছিন্নতার ধারণা দৃঢ়বদ্ধ হয়, যা পূর্ণ পরিণতি লাভ করে ১৯৪৯ সালে প্রকাশিত তার বাঙ্গালীর ইতিহাস গ্রন্থে। বার্মা থেকে কলকাতা ফিরে তিনি বর্মী ও মন (গড়হ) ভাষা শেখেন এবং বার্মার কারুশিল্প ও স্থাপত্য বিষয়ে গভীর পড়াশোনা শুরু করেন।

উনিশ শতকের বিশ ও ত্রিশের দশকে নীহাররঞ্জনের মানস গঠনকালে বাংলা ছিল বুদ্ধিবৃত্তিক ও আবেগাত্মক আবহের উদার মানবতাবাদ দ্বারা প্রভাবিত। তার কাজের জগতে মানুষ ও তার পরিপার্শ্বের সঙ্গে সংশ্নিষ্ট যা কিছু তিনি প্রত্যক্ষ করেছেন তা-ই তাকে আগ্রহী করে তুলেছে এবং আবেগ ও বুদ্ধি দিয়ে তিনি তা গ্রহণ করেছেন। সমকালীন দু'জন ব্যক্তি বঙ্কিমচন্দ্র ও রবীন্দ্রনাথ তাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেন, বিশেষত রবীন্দ্রনাথের জীবন ও কর্ম তার মধ্যে উদার মানবিক ভাবমূর্তির সৃষ্টি করে। বহুমুখী সৃজনশীল সাহিত্যকর্মে পরিস্ম্ফুট রবীন্দ্রনাথের ব্যাপক সর্বজনীন কৌতূহল বরাবরই তাকে অনুপ্রাণিত করেছিল।

পঁয়ত্রিশ বছরেরও অধিককাল নীহাররঞ্জন রায় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে সম্পৃক্ত ছিলেন। তিনি ছিলেন রিসার্চ ফেলো, প্রভাষক, বিশ্ববিদ্যালয়ের মুখপত্র ক্যালকাটা রিভিউর ব্যবস্থাপনা সম্পাদক, মুখ্য গ্রন্থাগারিক, রিডার ও প্রফেসর। তিনি স্বেচ্ছায় শিক্ষকতা পেশা বেছে নেন, ছেড়ে আসেন সাংবাদিকতা, যেখানে সুভাষ বসুর ইংরেজি দৈনিক লিবার্টির সাহিত্য সম্পাদক হিসেবে ইতোমধ্যেই সুপ্রতিষ্ঠিত ছিলেন।

১৯৮১ সালে মৃত্যুর কিছুকাল আগে তিনি 'বাঙ্গালীর ইতিহাস' গ্রন্থের দ্বিতীয় খণ্ড লেখার ইচ্ছা পোষণ করেন এবং তিনি মনে করেন যে, এটাই হবে তার 'সামান্য' বুদ্ধিবৃত্তিক জীবনের 'সর্বাধিক আনন্দময় পরিণতি'। কিন্তু তা আর পূর্ণ হয়নি।