করোনা-হানা ঠেকাতে ঘরবন্দি করে রাখা, অর্থাৎ আইসোলেশন, সোশ্যাল ডিস্ট্যান্সিং মেনে চলা, বার বার হাত ধোয়া, জীবাণুনাশক দিয়ে স্নান— এই অভ্যাসগুলো আমরা ক্রমে রপ্ত করে উঠেছি। কিন্তু এই অভ্যাসগুলো ভারতে নতুন নয়, বরং সাড়ে তিন হাজার বছরের পুরনো। ভারতীয় আয়ুর্বেদের পাতা ওল্টালে দেখা যায়, যিশুখ্রিস্টের জন্মের আগে থেকেই আইসোলেশন, পরিচ্ছন্ন থাকা, এমনকি, ২১ দিন গৃহবন্দি থাকার নিদানও রয়েছে।

চরক সংহিতার রচনাকাল গুপ্ত যুগ বা ৩০০ থেকে ৫০০ খ্রিস্টাব্দের বলে মনে করা হয়। সেখানে বিমানস্থান তৃতীয় অধ্যায়ে এপিডেমিক বা ‘জনপদ ধ্বংসনীয় বিমান’ নামের একটি অংশ রয়েছে। করোনা রুখতে ২০২০-তে দাঁড়িয়ে আমরা যে সব উপায় অবলম্বন করছি, তার অধিকাংশই সেখানে বর্ণিত। ‘জনপদ ধ্বংসনীয়’ অর্থাৎ গোটা সমাজকে ধ্বংস করে দিতে পারে এমন রোগের হানা ঘটলে কী ভাবে তার প্রতিকার সম্ভব, তা লেখা রয়েছে। 

এই অধ্যায়েই ১২-১৮ নম্বর শ্লোকে বলা হয়েছে, ‘রাসায়নানাং বিধিবচ্চোপযোগঃ প্রশস্যতে’। অর্থাৎ রোগ প্রতিবিধানে বার বার গরম জলে স্নান ও নিজেকে রাসায়নিক দিয়ে পরিচ্ছন্ন রাখলে ও রাসায়নিক ওষুধ প্রয়োগ করলে ভাইরাসকে মেরে ফেলা সহজ হয়। এখনও করোনা করোনা ঠেকাতে নানা ওষুধের প্রয়োগ ও বার বার পরিচ্ছন্ন থাকতে বলছেন বিশেষজ্ঞরা। স্যানিটাইজার ব্যবহার ও ভাল করে হাত-পা-মুখ বার বার পরিষ্কার করার যে নিদান এখন চিকিৎসকরা দিচ্ছেন, তা খ্রিস্টের জন্মের ৩০০-৫০০ বছর আগেই চরক জানিয়ে গিয়েছেন।

২১ দিন গৃহবন্দি থাকার নিদানও রয়েছে ভারতীয় আয়ুর্বেদে

শুধু তা-ই নয়, খ্রিস্টের জন্মের প্রায় ৪০০ বছর আগে লেখা ভারতীয় আয়ুর্বেদশাস্ত্রের অন্যতম সেরা গ্রন্থ ‘অষ্টাঙ্গহৃদয়’-এর শ্লোকে ২১ দিনের কোয়ারেন্টাইন বা আইসোলেশনের বিষয়টিও স্পষ্ট করা আছে। সেখান ৬৫ লম্বর শ্লোকে লেখা রয়েছে, ‘একবিংশোতিরাত্রেন বিষং শ্যাম্যতি সর্বথা’। অর্থাৎ যে কোনও বিষের (জীবাণু) প্রভাব কমে ২১তম দিনে। অর্থাৎ, বিষ বা জীবাণুতে আক্রান্ত রোগীকে ২১ দিন ঘরবন্দি রাখলে সে বিষ আর বাইরে সংক্রামিত করতে পারে না ও একুশতম দিনে এসে বিষের উপশম ঘটে। ফলে, আজকের পৃথিবীর লকডাউনের ধারণাও নতুন নয়। বরং ভারতীয় আয়ুর্বেদ তা অনেক আগেই নিদান দিয়ে রেখেছে।

পশ্চিমবঙ্গের কল্যাণীর বেঙ্গল ইনস্টিটিউট অব ফার্মাসিউটিক্যাল সায়েন্সের ভারপ্রাপ্ত অধ্যক্ষ ও আয়ুর্বেদ চিকিৎসক লোপামুদ্রা ভট্টাচার্যের মতে, ‘‘প্রাচীনকালের আয়ুর্বেদ চিকিৎসক চরক-সুশ্রুতের কথাই এখন মডার্ন মেডিসিন ঘুরিয়ে বলছে। মহামারি বা অতিমারি ঠেকাতে রোগীর পরিবারশুদ্ধকে আলাদা করে রাখার রীতি আয়ুর্বেদশাস্ত্রেই রয়েছে। শুধু চরক সংহিতা নয়, অষ্টাঙ্গহৃদয়তেও এমন নানা উপায় বর্ণিত আছে, যা মহামারি বা অতিমারির সময় বিশেষ ভাবে কাজে লাগে।’’

আয়ুর্বেদ মতে, ভারতীয় নানা মশলার মধ্যেও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা রয়েছে। 

যেমন: ‘চরক সংহিতা’র টিকাকার চক্রপানি দত্ত রোগের তিন প্রকার কারণসমূহ বলেছেন। তার মধ্যে অন্যতম, ‘অভিষঙ্গজ হেতু’। অর্থাৎ ভাইরাসের আক্রমণ। এই অভিষঙ্গজ বিষয়ে ‘সুশ্রুত সংহিতা’-র ৬ নং অধ্যায়ের ৩২ ও ৩৩ নম্বর শ্লোকে বলা হয়েছে, ‘‘প্রসঙ্গাদ গাত্রসংস্পর্শাৎ নিশ্বাসাৎ সহভোজনাৎ।/ সহশয্যাসনশ্চাপি বস্ত্রমাল্যানুলেপনাৎ।।’’ অর্থাৎ ভাইরাস আক্রান্তকে ছোঁয়ার মাধ্যমে, তার হাঁচি-কাশির ড্রপলেটের মাধ্যমে, তাঁর সঙ্গে বসবাস, একই থালায় খাওয়া, একই বিছানায় শোওয়ার মতো কাজ করলে সুস্থ মানুষও তাঁর সংস্পর্শে এসে অসুস্থ হয়ে পড়বেন। এই শ্লোকেই শেষের দিকের পঙ‌্ক্তিতে বলা হয়েছে, ‘‘ঔপসর্গিক রোগশ্চ সংক্রমন্তি নরানরং।’’ অর্থাৎ, উপসর্গগুলি এক জনের থেকে অন্য জনে সহজেই ছড়িয়ে পড়তে পারে। এই সোশ্যাল ডিস্ট্যান্সিংয়ের ধারণাটিও এখান থেকেই পাওয়া। চরক সংহিতার তিস্রৈষণীয় অধ্যায়ে তিন প্রকার ইমিউনিটি-র (আয়ুর্বেদের ভাষায় ‘বল’) কথা রয়েছে— বলমিতি সহজং, কালজং ও যুক্তিবৃতঞ্চ। যে কোনও ভাইরাস থেকে মুক্তি পেতে দেহের জন্মগত রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা, কাল বা বয়সের সঙ্গে সঙ্গে অর্জিত রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ও টিকার মাধ্যমে অর্জিত রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাকে কাজে লাগানোর কথা বলা হয়েছে। করোনা থেকে মুক্তি পেতেও শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ানোর কথাই বলছেন আধুনিক চিকিৎসকরা।

আয়ুর্বেদ চিকিৎসক ও গবেষক সুজন সরকারের মতে, ‘‘ভারতীয় এই আয়ুর্বেদকে আশ্রয় করে করোনা রোধে পৃথিবীর অনেক দেশই এগিয়ে এসেছে। এক সময় চরক ও সুশ্রুত সংহিতা নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানো হত। তখনই এই দুই গ্রন্থের প্রতিলিপি ও অনুবাদ পাড়ি দেয় চিন, তিব্বত ও অন্যান্য পূর্ব এশীয় দেশে। তাই সে সব দেশে ভারতীয় আয়ুর্বেদের প্রভাব রয়েছে। আজ করোনা ঠেকাতে তাই চিনও সেই সব প্রাচীন গ্রন্থের নিদান আঁকড়ে মোকাবিলা করছে। ভারত-সহ গোটা বিশ্বও সেই পথেই হাঁটছে। আধুনিক চিকিৎসাশাস্ত্র যে সব উপায়ের কথা বলছে, তা মূলত সনাতনী আয়ুর্বেদ থেকেই নেওয়া, কেবল তার প্রয়োগে আধুনিকীকরণ করা হয়েছে। তখন কাপড় বা সুতিবস্ত্র দিয়ে নাক-মুখ চাপা দেওয়া কথা বলা হয়েছে, এখন তা-ই মাস্ক। জল ও বায়ুবাহিত ভাইরাস মারতে বার বার গরম জলে স্নান ও গরম জল পান করার বিধানও রয়েছে এখানে।’’

এ কালের করোনা প্রতিরোধ ও রোগের প্রকার নির্ণয়ের বীজ আসলে পড়ে রয়েছে সাড়ে তিন হাজার বছরেরও বেশি পুরনো ভারতীয় আয়ুর্বেদে।